Tuesday, May 7, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়গ্রামীণ রোগী বনাম নাগরিক রোগী

গ্রামীণ রোগী বনাম নাগরিক রোগী

  • সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

ঘটনা ১

সালটা ২০০২-’০৩ হবে। আমি তখন উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে পোস্টেড।

এক শীতের সকালে রাধিকাপুর অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছি স্বাস্থ্য শিবির করতে। টাঙন নদীর পাড়ে নেমে শীর্ণ রেলসেতু পেরিয়ে, ওপারে পৌঁছে হাঁটছি। পথের দু’পাশে গমের খেত, ইতিউতি টিনের চালের বাড়ি। একটি ঘরের সামনে এক বৃদ্ধা রাজবংশী মহিলা দাঁড়িয়ে। ওই মারাত্মক ঠান্ডাতেও পরনে কেবল একটি হাঁটু অবধি ঝুলের মোটা উলের চাদর– বুকের কাছে গিঁট দেওয়া। মুখে বয়সের অজস্র আঁকিবুকি, চোখে কৌতূহল।

‘কোথথিকে আসতিছ তোমরা?’

‘কালিয়াগঞ্জ হাসপাতাল থেকে গো মাসি। ওই সামনে ইস্কুলবাড়িতে ক্যাম্প বসবে। তোমার বা বাড়ির কারও কোনও অসুখবিসুখ থাকলে নিয়ে এসো, দেখে ওষুধ দিয়ে দেব আমরা’।

বিস্মিত গলা বলে,

‘কালিয়াগঞ্জ? সে তো ম্যালা দূর শুনসি’—

‘সে কি মাসি, তুমি যাওনি কখনও?’

কৌতূহল বদলে গেল ঔদাসীন্যে। সম্রাজ্ঞীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে জবাব দিলেন বৃদ্ধা— ‘ন্যাঃ, রাধিকাপুরই দেখি নাই কখনও।’

প্রচণ্ড অবাক হয়ে শহুরে আমি প্রশ্ন রাখি।

‘শরীর টরির খারাপ হলে যাও কোথায় তাহলে? রাধিকাপুরেই তো সবচেয়ে কাছের সাব-সেন্টার’—

ঠোঁট উলটে ঘরে ঢুকে যান রমণী– এত বছরেও যাঁর হয়তো জানা হয়ে ওঠেনি, ঘর থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে সরকারি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে উপলব্ধ রয়েছে সাধারণ অসুখবিসুখের জন্য সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের ওষুধ ও প্রশিক্ষিত নার্সদিদিদের পরামর্শ।

ঘটনা ২

আরও কিছু বছর এগিয়ে এসে আমি তখন হাওড়া পুরসভার কাছাকাছি একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত। ২০০৬-এর এক গাঢ় হেমন্তের রাতে ডিউটি করছি। পাশের রাস্তায় ধাবমান ট্রাকের শব্দ ছাপিয়ে গেটের কাছে চ্যাঁচামেচি শুনলাম। খানিক বাদে একজন পুরুষ, একটি মহিলা দু-তিনটি শিশু সহ গেটকিপারের বাধা অগ্রাহ্য করেই ইমার্জেন্সি ঘরের মধ্যে ঢুকে এল।

‘কী হয়েছে? কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?’

শীতের রাত্তিরে রাস্তার ধারের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অত লোকজন দেখে দুর্ঘটনার কথাই মনে এসেছিল প্রথমে।

পুরুষটি ধীরেসুস্থে চেয়ারে বসে জানাল, দুর্ঘটনা নয়, তার নিজের দু’-তিনদিন ধরে গ্যাস অম্বলের সমস্যা হচ্ছে। বৌটির পুরোনো গাঁটের ব্যথা চাগাড় দিয়েছে শীত পড়ার পরেই। আর বাচ্চাগুলোর খোসপাঁচড়ার ওষুধ চাই, চুলকুনি বেড়ে গিয়েছে রুক্ষ ত্বকে।

অবাক হয়েছিলাম।

‘এগুলোর জন্য তো আউটডোরে আসতে পারতে– এর একটাও তো ইমার্জেন্সি নয়। ইমার্জেন্সি বোঝো তো– যাকে জরুরি প্রয়োজন বলে’ –

আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে গৃহকর্তাটি দাবড়ে উঠল—‘আউটডোর তো দিনের বেলা। আমি হাওড়ার লেদ কারখানায় কাজে যাই, রাতে ফিরি। বৌ চাঁপাতলায় হোটেলে রান্নার কাজ করে, কাজ কামাই দিয়ে দিনের বেলা আসব? কেন, গরমেন্ট তো ওষুধের সাপ্লাই দিয়েই রেখেছে’– পাশের ওষুধপত্রের পেটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল লোকটি–‘আপনারাও রয়েছেন বসে, দেখে ওষুধ দিতে অসুবিধা কোথায়?’

কথা না বাড়িয়ে দেখে দিলাম গোটা পরিবারকে, একে আপৎকালীন পরিষেবা বোঝানো আমার কর্ম নয়, বাইরে রাত ও হিম, দুটোই বাড়ছে।

সব ওষুধপত্র বুঝে নিয়ে বেরোবার আগে লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলে গেল— ‘আমাদের ইমার্জেন্সি দেখাবেন না, গরিব মানুষের সবসময়ই ইমার্জেন্সি, বুঝলেন?’

বুঝলাম, শহরের উপচ্ছায়ায় থাকা পরিবারটি তার স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন, প্রয়োজনে বকে ধমকেও তা আদায় করে নিতে সক্ষম।

প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছোনো ইস্তক জোড়হাত করে থাকে। ভাবে, সবটাই সরকারের দাক্ষিণ্য— তাই সর্বদাই নুয়ে থাকে কৃতজ্ঞতায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যের অধিকারটি যে তাদের হকের পাওনা, এটুকু বুঝতেই উত্তরবঙ্গের বৃদ্ধাটির মতো কতজনের এক জীবন কেটে যায়।

ঘটনা ৩

উত্তরবঙ্গে কাজ করার সময়, পালস পোলিও কর্মসূচি চলাকালীন আমাদের ব্লকটিতে দু-একটি শিশুর ডায়ারিয়া হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। কারণ হিসেবে টিকাকরণকে চিহ্নিত করে কিছু গ্রামের মোড়লরা টিকা বয়কটের ডাক দিয়েছিল। ব্লক হাসপাতাল থেকে মেডিকেল টিমকে যেতে হয়েছিল গ্রামবাসীদের বোঝানোর জন্য। সেই টিমের সদস্য হিসেবে এক মাতব্বরের বাড়িতে ঢুকেই মাটির উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় চাটাই পেতে বসার সাদর আমন্ত্রণ পেয়ে চমকে গিয়েছিলাম। খানিক পরেই ফাটা কাচের বাটিতে জোলো দুধের সেমাইয়ের আন্তরিক আপ্যায়নে চমক দ্বিগুণ হয়েছিল মনে আছে। প্রতিরোধ এবং দুর্ব্যবহারের আশঙ্কা করে যেখানে গিয়েছিলাম, সেখানে এমন অভ্যর্থনা অবাক তো করবেই।

ঘটনা ৪

বছর দশ-বারো আগে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ব্লাডব্যাংকের পক্ষ থেকে বেলঘরিয়ার একটি পাড়ায় গিয়েছি রক্তদান শিবিরের কাজে। পাড়ার পাঠাগারে অনুষ্ঠিত শিবিরটি শেষ হওয়ার পরে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে শৌচাগার ব্যবহারের দরকার হল।

দেখা গেল পাঠাগারের একমাত্র শৌচাগারটি ভগ্নপ্রায়, দরজাবিহীন এবং আবর্জনাপূর্ণ।

ব্লাডব্যাংকের ছেলেরা ওরই মধ্যে ‘ম্যানেজ’ করে চলে গেলেও, আমি পারলাম না। উদ্যোক্তাদের একজনকে অনুরোধ করলাম কারও বাড়ির শৌচালয় ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য। তারপর কর্মকর্তাদের মধ্যে আরম্ভ হল দায় ঠেলাঠেলি। বোঝা গেল, বহিরাগতকে ব্যক্তিগত শৌচালয় ব্যবহার করতে দিতে অনেকেরই ‘অন্দরমহল’ নারাজ, সে যতই মেডিকেল কলেজের লেডি ডাক্তার হোক না কেন!

এই সংকীর্ণতা হয়তো খবরের কাগজ বা টিভির মাধ্যমে নানারকম ভীতিজনক অভিজ্ঞতা জানতে পারার ফসল। বস্তুত, সম্ভাব্য দুর্বৃত্তায়ন ঠেকাতে ঘরে ‘বাইরের লোক’ না ঢোকানোর সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য শহুরে নাগরিক সমাজকে বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। গ্রাম তার সারল্য আর সহজতা নিয়ে অনেকটাই অবারিত দ্বার বলে আমার মনে হয়েছে।

গ্রামীণ সমাজে দেখনদারি কম, আন্তরিকতা বেশি ছিল। কোনও আনন্দানুষ্ঠানে, নিমন্ত্রিত বাদ দিয়েও বহু অনাহূত মানুষকে সপরিবারে সাড়ম্বরে আপ্যায়িত হতে দেখেছি। ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, মাছের কালিয়া, খাসির মাংস, চাটনি আর মিষ্টি হলেই এলাহি আয়োজন হয়েছে ধরে নেওয়া হত। এরই বিপ্রতীপে, নাগরিক সমাজের যে কোনও অনুষ্ঠানে, ধনী-দরিদ্র আয়োজক নির্বিশেষে অন্তত পনেরো ষোলো পদের কেটারিং নইলে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি পড়তে দেখেছি। অনাহূত দূর অস্ত, আমন্ত্রিত অতিথিদের নির্বাচনও সেখানে মাথা গোনা, সকলেই সপরিবার নিমন্ত্রিত নন। দলবেঁধে কুটুম্বিতা করতে যাওয়াটা এখানে অসভ্যতা। ছোট ছোট খোপের বাসস্থানের মতো নাগরিক হৃদয়ও ছোট হয়ে গিয়েছে, উদাত্ত গেঁয়ো আতিথেয়তার স্থান সংকুলান হয় না এখানে।

ধীরে ধীরে সময় যত গড়িয়েছে, প্রসারিত হয়েছে সর্বভুক বিশ্বায়নের থাবা, শহর ও গ্রামের ভেদাভেদ সম্পূর্ণ মুছে না গেলেও অস্পষ্ট হয়ে এসেছে অনেকটাই।

এখন গ্রামেও হরেক রকম মেলার নামে শুরু হয়ে গিয়েছে শহুরে কার্নিভাল, নামীদামি ফুড চেন আর শপিং মল তাদের শিকড় ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। হাতে হাতে ঘুরছে স্মার্টফোন, সর্বত্র মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ডিজিটাল লেনদেনে।

এর সবটাই খারাপ, এমন অবাস্তব দাবি করছি না, তবে কোথাও যেন গ্রাম তার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে বলে মনে হয়।

তাই অসহায়ের মতো দেখতে হয় চিকিৎসা নিয়ে অসন্তুষ্ট, ক্ষিপ্ত রোগীর পরিজন কখনও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের সুপারকে টেনে বের করে মুখে বিষ্ঠা মাখিয়ে দিচ্ছেন, কখনও বা সশস্ত্র শোকাকুল পরিজনদের হাতে নিগৃহীত হয়ে খুলির হাড় ফেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন তরুণ জুনিয়ার ডাক্তার।

নৈরাজ্যে, হিংসায় মিলে যাচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা আর কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ।

(লেখক চিকিৎসক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Mithun Chakraborty | মোদির থেকে মেসেজের উত্তর পেতে কতক্ষণের অপেক্ষা? উত্তর দিলেন মিঠুন

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, তাঁকে পাঠানো মেসেজের উত্তরও খুবই তাড়াতাড়ি দেন বলে জানালেন মিঠুন চক্রবর্তী। পদ্মশ্রী সম্মানে...

CV Ananda Bose | ‘দিদিগিরি সহ্য করব না’, কলকাতায় ফিরেই মমতার রাজনীতিকে ‘নোংরা’ তকমা...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা অভিযোগের পালটা জবাবে কড়া ভাষায় আক্রমণ করলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। এর আগে নির্বাচনি প্রচারে রাজ্যপালের...

Elephant | চা বাগানের জলাধারে পড়ল শাবক সহ মা হাতি, তিন ঘণ্টার অপারেশন শেষে...

0
জলপাইগুড়ি: বীরপাড়ার মাকড়াপাড়া চা বাগানের গভীর জলাধারে পড়ে যাওয়া মা হাতি ও হস্তিশাবককে দীর্ঘ তিন ঘণ্টা অপারেশন চালিয়ে উদ্ধার করল বন দপ্তর। রবিবার গভীর...

Leopard Attack | চিতাবাঘের হামলায় জখম তরুণ, আতঙ্ক এলাকায়

0
ময়নাগুড়ি: দিনদুপুরে চিতাবাঘের হামলায় (Leopard Attack) জখম হল বছর ২০-র এক তরুণ। ঘটনাটি ঘটেছে ময়নাগুড়ি (Maynaguri) ব্লকের রামশাই গ্রাম পঞ্চায়েতের বারোহাতি সেনপাড়ায়। জখম আকাশ...

Lok Sabha Election | মঙ্গলে মালদার দুই কেন্দ্রে ভোট, অশান্তি রুখতে তৎপর কমিশন

0
মালদা ও চাঁচল: তৃতীয় দফায় মঙ্গলবার মালদার দুই লোকসভা কেন্দ্রে ভোট। নির্বাচনি অশান্তি এড়াতে তৎপর কমিশন। প্রতিটি বুথে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। এছাড়াও থাকবে কেন্দ্রীয়...

Most Popular