Monday, May 13, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়অল্পে রুষ্ট নয়, স্বল্পে তুষ্টির মাহাত্ম্য শিবরাত্রিতে

অল্পে রুষ্ট নয়, স্বল্পে তুষ্টির মাহাত্ম্য শিবরাত্রিতে

নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

শিবকে কেন্দ্র করেই শিবরাত্রি। আমরা দিনটি পালন করি ব্রত হিসাবে। এ বিষয়ে একটি কাহিনী আছে স্কন্দপুরাণে। চণ্ড বা চণ্ডাল শিকারি। সে খুব ক্রূর প্রকৃতির। পশু মেরে বেড়ায়। মায়াদয়াহীন। মাছ ধরে। সে দুরাত্মাও বটে। পশুপাখি হত্যা করায় তার দ্বিধা নেই। ব্রাহ্মণদেরও উত্ত্যক্ত করে। তাই বোধহয় তার নাম লুব্ধক। লুব্ধক অর্থাৎ ব্যাধ।

এক রাতে সে বেল গাছের ওপর উঠে পড়ল। তার প্রবৃত্তি হল বরাহ বা শূকর বা কোল ধরার। ওদিকে বহু অপেক্ষার পরেও শূকর তার চোখে পড়ে না।  সময় বয়ে যায়। ঘন পল্লবিত বিল্ববৃক্ষ। একসময় রাগে সে বিল্বপত্র ছিঁড়ে ফেলতে থাকে। বহুক্ষণ ধরে এমন বেলপাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে হাতে তার কষে ধরে গেল। জল নিয়ে হাত ধুয়ে সে তা নীচে ফেলে দিল।

সেই এক গণ্ডূষ জল গিয়ে পড়ল বেল গাছের তলায় থাকা শিবলিঙ্গের ওপর। এ সবই ঘটল চণ্ডের অজ্ঞাতেই। এর ফলে আশুতোষ শিব খুবই তুষ্ট হলেন। এত তুচ্ছ কাজেও শিবের পরিতৃপ্তি সাধন হল। ওদিকে লুব্ধকের অপেক্ষায় তার স্ত্রী। তার নাম ঘনোদরী। বনের মধ্যে স্বামীকে খুঁজতে বেরোল সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সে দেখতে পেল, লুব্ধক মাছ ধরছে। স্বামীকে বলল, সারারাত তুমি ঘরে ফিরলে না বলে আমিও খাওয়াদাওয়া করিনি। শেষমেশ তোমাকে খুঁজতে বেরিয়েছি। স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে, সেটা ছিল মাঘ মাস। কৃষ্ণপক্ষ ও চতুর্দশীর দিন। কিন্তু তিথির ফেরে দিন সরে গিয়ে ফাল্গুনেও পড়ে।

একসময় বাড়ি ফিরে লুব্ধকের স্ত্রী খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করল। কিন্তু এত ঘোরাঘুরির পর স্নান করবার দরকার। তারা গেল স্নান করতে। ওদিকে এক কুকুর এসে তাদের রাখা খাবার খেয়ে গেল। ঘনোদরীর খুব রাগ হল। সে গেল কুকুর মারতে। হঠাৎ ব্যাধের মধ্যে একটা ভাবান্তর হল। সে বলল, কী আর করা যাবে, কুকুরটারও আমাদের মতো খিদে পেয়েছিল বোধহয়। তাই খেয়েছে। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে কুকুরটা খেয়ে গেছে বলে। ঘনোদরী, তুমি শান্ত হও। দুঃখ কোরো না। স্বামীর এমন পরিবর্তনে স্ত্রী বিস্মিত হল।

এমন সময়ে শিবলোক থেকে মর্ত্যভূমিতে, ব্যাধের ঘরে উপস্থিত হলেন জনাকয়েক শিবানুচর। তাঁদের গলায় রুদ্রাক্ষ, গায়ে ভস্ম। তাঁরা ব্যাধকে জানালেন, তুমি তোমার অজান্তেই খুব পুণ্য কাজ করেছ। ব্যাধ জানতে চাইল, কী সেই কাজ? আগত শিবানুচররা জানালেন, আগের রাতে বিল্ববৃক্ষে চড়ে সে যে বেলপাতা তুলে নীচে ফেলেছে, সেগুলি শিবের মাথায় গিয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে সে এক গণ্ডূষ জলও ফেলেছে। তাতে শিবের স্নান হয়ে গেছে। এবং ব্যাধ যে না খেয়ে ছিল, সেইসঙ্গে রাত্রি জাগরণ করেছে, এতে শিব মহাতুষ্ট হয়েছেন। অন্যদিকে, তোমার স্ত্রীও ব্রত পালনের যাবতীয় নিয়ম পালন করেছেন। তাছাড়া, তুমি তো বিল্বপত্র ও জল শিবের মাথায় ঢেলেইছ। তোমরা দুজন শিবলোকে চলো।

এভাবেই নাকি শিবরাত্রির ব্রত পালন। এই কাহিনীর পিছনে রয়েছে একটা সামাজিক ভাবনা। শিবের পুজো যেমন-তেমন করেই করা হোক না কেন, তিনি অল্পেই তুষ্ট। শিবের মতো আর কোনও দেবতাই এত স্বল্পে তুষ্ট নন। পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যে অন্য ইঙ্গিত রয়েছে। প্রাপ্তি কম হলেও ভালো থাকার, সুখে থাকার, শান্তিতে থাকার ইঙ্গিত রয়েছে এর মধ্যে।

আমাদের দেশই বোধহয় একমাত্র সেই উদার জায়গা, যেখানে পরম আরাধ্য দেবতাকেও আমরা ঘরসংসারের মধ্যে নিয়ে এসে তাঁকে দিয়ে যা ইচ্ছে করাতে পারি। তাঁকে যেন আমরা প্রতি পলে স্পর্শ করতে পারি, তাঁর কাছে আমরা দুঃখ-কষ্ট জানাতে পারি। এমনকি জীবন কাটাতে অসুবিধে হলে গালাগালিও দিতে পারি। অথচ সকাল-বিকেল তাঁর পায়ে পরম ভক্তিতে ফুল-বেলপাতা নিবেদন করে আমার সর্বস্বভার তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে আমাদের কোনও লজ্জা করে না। দিনের পর দিন গৃহস্থের ঘরে পুজো পেতে পেতে একদিন তিনি ঘরের অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন। শিব সেই দেবতা।

পুরাণে রয়েছে, দাক্ষায়ণী সতী দক্ষযজ্ঞে আত্মাহুতি দিয়ে পরজন্মে নিজেকে দুইভাগে ভাগ করে গঙ্গা আর উমারূপে মেনার গর্ভে জন্মালেন। পরে পার্বতী যেমন শিবজায়া, গঙ্গাও একইভাবে শিব-সহচরী, বড় বৌই বটে। কিন্তু শিবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা খানিক লুকানো-চুরানো। তার মধ্যে অন্য পৌরাণিক দৃষ্টিতে ভগীরথের গঙ্গানয়ন-কাহিনীতে আকাশ থেকে গঙ্গা শিব-জটাজালের মধ্যে প্রথমে অবতরণ করে এবং সেই সূত্রেও তিনি শিবের পত্নী। ঈশ্বরী পাটনীর ভাষায় ‘গঙ্গা নামে সতা তাঁর তরঙ্গ এমনি। জীবন-স্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।’ গঙ্গা শিবের জটায় শোভা পান মুক্তোমালার মতো ললাটদেশে।

মুদ্রারাক্ষসের মতো রাজনৈতিক নাটকে নাট্যারম্ভে নাট্যকার তাঁর দর্শক এবং অভিনেতাদের জন্য আশীর্বাদ চাইছেন শিবের কাছে। আর ঠিক এইখানেই কবির কৌতুক-চাতুরী। নাট্যারম্ভের মঙ্গল শ্লোকে শিবজায়া পার্বতী শিবের উদ্দেশে সকটাক্ষে প্রশ্ন করছেন, তোমার মাথায় এই ধন্যিমানি বস্তুটা কে গো? শিব বোকা সেজে উত্তর দিলেন। কেন, ও তো শশীকলা। বাঁকা চাঁদ আমার মাথায় শোভা পাচ্ছে। পার্বতী বললেন, বলি, নামটা কী ওর! ওর একটা নাম আছে তো না কি? শিব আবারও বোকা সেজে জানালেন, আমি তো বললাম নামটা, এই শশীকলা তোমার অনেক কালের চেনা, তুমি সেটা ভুলে গেলে কী করে, সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি আমি! পার্বতী আর দেরি না করে একেবারে, চাঁছাছোলা ভাষায় বললেন, আমি এই মেয়েছেলেটার কথা জিজ্ঞাসা করছি। বলি, এই মেয়েটা কে? শশীকলার কথা আমি থোড়ি জিজ্ঞাসা করেছি!

শিব এবার পার্বতীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে পার্বতীর সখী বিজয়াকে সাক্ষী মানার চেষ্টা করলেন। ধরা পড়ে যাবার সমস্ত চিহ্ন প্রবল করে তুলে, আমতা আমতা করে শিব বেশ দার্শনিক ভাবেই বললেন, আচ্ছা, তুমি বলো বিজয়া! শশীকলা, অর্থাৎ কিনা চাঁদও যদি চাঁদের অস্তিত্ব প্রমাণ না করে, তাহলে…। ঠিক এই মুহূর্তেই কুশলী কবি বিশাখ দত্ত ঝাঁপিযে পড়ে শ্লোক-শেষের পংক্তি লিখে বললেন, এই যে শিব মস্তকস্থা সুরনদী গঙ্গাকে পার্বতীর কাছ থেকে শঠতা করে লুকোতে চাইছেন, এই শিব-শাঠ্যই তোমাদের সকলকে রক্ষা করুন।

সত্যি বলতে কী, এই যে একান্ত মনুষ্যের জগৎ যেখানে স্ত্রীর প্রতি বশংবদতা প্রমাণ করার জন্য এবং অন্যতর আকর্ষণ লুকোনোর জন্য মনুষ্যোচিত শঠতার প্রয়োজন হয়, সংসারে অশান্তির জন্য বিষপান করতে হয়, অথবা এমনতর এক ছোট্ট অসহায়তা যেখানে যৌবনবতী স্ত্রী প্রতিনিয়ত খেয়াল করেন, বয়স্ক স্বামীর চুলে পাক ধরছে কি না, আমাদের সংবেদনশীল কবিরা কিন্তু পৌরাণিক মহিমান্বিত শিবকে এই অবান্তর জগতে এনে ফেলেছেন। ওই যে একটু আগে শৈলসুতা-সপত্নী গঙ্গার কথা বললাম, তো তিনি যখন একা থাকেন, তখন তো আর সপত্নীর ভয়ে কুঞ্চিত হন না। তাছাড়া সেই হিমালয় থেকে অবতরণ করার সময়ে তো শিবের ভালোবাসার জটাজালে প্রথম থেকেই জড়িয়ে পড়ায় খানিকটা অন্তরালেই থাকার সুযোগ পান। তবে শিবের জীবনে তিনি যেভাবেই জড়িয়ে থাকুন, আমাদের কবি বলেছেন যে, এই বয়স্ক স্বামীটির জন্য তাঁর অনন্ত মমতা। কবি বলেছেন, সেই ধূর্জটির জটাজুট আমাদের সমস্ত বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে দিক। এ হল সেই জটাজাল, যার জন্য সর্বদা ভেবে মরেন গঙ্গা, খালি তিনি খুঁজে বেড়ান তাঁর একটি জটাতেও পাক ধরেছে কি না!

শিব-মহাদেবের মতো নটরাজ তাণ্ডবীকে এই যে একটু বৃদ্ধ করে দেখানো, কোনও দিকে তাঁর হুঁশ নেই, তালতোল নেই, খানিকটা জবুথবুভাবে এই শিবকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যেই আমার মহাকবিরা সমাজসাধক দার্শনিক হয়ে ওঠেন।

বিরাট পুরুষের এই অতিলৌকিক স্বভাবটাই কিন্তু সংসারের কোনও দিকে না তাকানো, আত্মভোলা, নির্বিকার, দায়িত্বজ্ঞানহীন বাঙালি ভারতীয়ের সঙ্গে মিলে যাবে। শিব কিন্তু এইরকম এক ঈশ্বর-পুরুষের প্রতিরূপ, তিনি শবের মতো পড়ে থাকেন শক্তিমায়ের পদতলে, আর শিবশক্তিই তাঁকে সর্বকর্মে চালিত করেন।

এই দার্শনিক জটিলতাকে আমাদের কবি কিন্তু প্রাত্যহিক জীবন-সরসতার মধ্যে সেই সরল যুবকটির মতো করে দেন, যার কোনও চালচুলো ছিল না আগে, অথচ নতুন বিয়ে করার পর তার চাকচিক্য বেড়ে গেল। কবি লিখেছেন, কী না করেছেন শিব এই বিয়েটুকু করার জন্য! শিবের একটা বিশেষ দিকই হল তিনি দিগ্বসন, দিগম্বর। যিনি নগ্ন, তাঁর বসন হিসাবে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের দিকগুলি প্রধানত কাজ করে। শিব সেই দিগম্বর ত্যাগ করে ভালো কাপড় পরেছেন, যত্রতত্র এখন আর থাকেন না, এখন শ্বশুর-বাবা হিমালয়ে বনস্থলীতেই নিজের মতো একটা বাসা করেছেন কৈলাসে। এখন আর তিনি ভস্ম-টস্ম মাখেন না। গায়ে চন্দন-কুঙ্কুমে সাজেন এখন। সত্যি এই শিব তোমাদের রক্ষা করুন, যিনি পার্বতীকে শুধু বিয়ে করেই এমন গৃহস্থ হয়ে গেলেন।

বিয়ে করে শিব এমন পরিপাটি করে সংসারে ঢুকলেও এটা যে শিবের আসল স্বভাব-পরিচয় নয়, সেকথা জানেন অন্য রসিক কবিরা। এ নিয়ে আমাদের কাব্যাদির শেষ নেই। কিন্তু কথা হল, শিবরাত্রির মাহাত্ম্য এখানেই যে, অল্পে রুষ্ট নয়, স্বল্পে তুষ্ট থাকাই জীবনের মাধুর্য।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Firecracker Explosion | শিবকাশিতে আতশবাজি কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ, মৃত বেড়ে ৮

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ তামিলনাড়ুর শিবকাশিতে আতশবাজি কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮। শিবকাশি যা ভারতের আতশবাজি বানানোর মূলকেন্দ্র হিসাবে বিবেচিত হয়...

CV Ananda Bose | শ্লীলতাহানি কাণ্ডে রাজভবনের ৪ কর্মীকে তলব পুলিশের, তদন্ত নাপসন্দ, মুখ্যসচিবকে...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ রাজভবনের অন্দরে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলেছেন রাজভবনে কর্মরত এক অস্থায়ী মহিলা কর্মী। এই ঘটনায় তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন...

Rekha Patra | ‘রোহিঙ্গারা হামলা করছে…’, রেখা পাত্রর মুখে সন্দেশখালি নিয়ে বিস্ফোরক দাবি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সন্দেশখালির অশান্তি নিয়ে এবার বিস্ফোরক দাবি করলেন বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র। রেখার অভিযোগ, ‘রোহিঙ্গারা সন্দেশখালিতে গিয়ে হামলা করছে। একজনের...

Acid Attack | স্ত্রী’কে অ্যাসিড ছুড়লেন স্বামী, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে জখম ছেলে

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: স্ত্রী-র সঙ্গে বিবাদের জেরে অ্যাসিড ছুড়েছিলেন স্বামী। কিন্তু স্ত্রী বেঁচে গেলেও সেই অ্যাসিডে পুড়ে গিয়ে গুরুতর জখম হল ছেলে। ঘটনাটি...

IPL-2024 | ৫ উইকেটে রাজস্থানকে হারিয়ে প্লে অফে যাওয়ার আশা জিইয়ে রাখল চেন্নাই  

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ৫ উইকেটে রাজস্থানকে হারিয়ে আইপিএলের প্লে অফে যাওয়ার আশা জিইয়ে রাখল চেন্নাই। এদিন প্রথমে ব্যাট করে রাজস্থান রয়্যালস ৫ উইকেট...

Most Popular