Tuesday, May 14, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ব্রিগেডে আলো জ্বেলেও আঁধারে বামেরা

ব্রিগেডে আলো জ্বেলেও আঁধারে বামেরা

  • দেবাশিস দাশগুপ্ত

ধরা যাক, সন্দেশখালির এই ঘটনা বাম জমানার। শেখ শাহজাহান সিপিএমের জেলা পরিষদের হার্মাদ সদস্য। উত্তম আর শিবু শাহজাহানের শাগরেদ। তারাও সিপিএমের জেলা পরিষদ সদস্য। সকলের বিরুদ্ধেই জমি দখল, চাষের জমিতে নোনা জলে ঢুকিয়ে দেওয়া, রাতবিরেতে বাড়ির সুন্দরী বৌ বা মেয়েদের পার্টি অফিসে ডেকে এনে তাঁদের পিঠে তৈরির কাজে লাগানো, না এলে তাঁদের স্বামীদের মারধরের ভূরিভূরি অভিযোগ। গ্রামের মহিলারা দীর্ঘদিন ধরে এই হার্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করেছেন। উলটে পুলিশ বলেছে, ওদের সঙ্গে ঝামেলা মিটিয়ে নাও।

ধরা যাক তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী। গ্রামের মহিলাদের সিপিএমের ওই হার্মাদদের অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। তাঁরা লাঠি, ঝাঁটা হাতে রাস্তায় নেমেছেন।

ধরা যাক, নিরাপদ সর্দার বিরোধী দলের প্রাক্তন বিধায়ক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনের জল, জঙ্গলের মানুষের জন্য লড়াই করছেন। তাঁকেই শাসকদলের কর্তাভজা পুলিশ গ্রামের মানুষকে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। সব মিলিয়ে এলাকা উত্তাল।

তখন বিরোধী নেত্রী কী করতেন? নিরাপদর মতো লড়াকু নেতাকে তিনি পারলে পুলিশের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতেন। যেমন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ভবানীপুর থানা থেকে এক দুষ্কৃতীকে ছিনিয়ে এনেছিলেন। দরকার হলে তাঁর নেতৃত্বে তৃণমূল বাহিনী সন্দেশখালি থানা ভাঙচুর করত। চলত দিনের পর দিন পথ অবরোধ। দু’একটা বাংলা বনধ হয়ে যেত। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হলেও তাতে কিছু এসে যেত না। আর শাসকদল ছোট ঘটনা বলে দায় এড়িয়ে যেত। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিধানসভায় দাবি করতেন, শাহজাহান ভালো ছেলে। ইডি ওকে টার্গেট করেছিল।

কিন্তু এই জমানায় সে সব কিছুই হল না। একটা বাংলা বনধ হল না, কলকাতার রাস্তায় একটা বাস, ট্রাম পুড়ল না। যদিও এখন কলকাতার রাস্তায় ট্রাম প্রায় উঠে গিয়েছে। শাসকদলের প্রাক্তন মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অবশ্য বলেছেন, সিপিএম জমানা হলে গুলি চলত।

হেঁয়ালি ছেড়ে একটু বাস্তবে আসি। এতক্ষণ ধান ভানতে শিবের গীত গাইছিলাম। নিন্দুকেরা বলাবলি করছে, সন্দেশখালিতে এত সব হচ্ছে। কিন্তু সিপিএমকে কেন সেভাবে পথে দেখা যাচ্ছে না। অন্যান্য বাম দলই বা কোথায়। মাঝে বামফ্রন্টের এক ছোট শরিক ফরওয়ার্ড ব্লক সন্দেশখালি যেতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে রাস্তায় বসে পড়েছে। এক নেতাকে দেখলাম, গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে বসে। আন্দোলনের সঙ্গে খালি গায়ের কী সম্পর্ক, বুঝি না বাপু।

সন্দেশখালির ঘটনাবলি দেখে মনে হচ্ছে, লোকসভা ভোটের মুখে জঙ্গি আন্দোলনের ঠিকা বোধ হয় সিপিএমের থেকে বিজেপি হাইজ্যাক করে নিল। বলতে দ্বিধা নেই, এই পর্বে বিজেপিকে যত সক্রিয় দেখা গেল, তার ধারেকাছে দেখা গেল না সিপিএমকে। অথচ এই সিপিএমের যুব শাখা ডিওয়াইএফ মাত্র দেড় মাস আগে ব্রিগেডে কী বিশাল সমাবেশ করল। তাদের মঞ্চে শুধু যুব নেতৃত্বের উপস্থিতি। সিপিএমের পাকা চুলের সব নেতা মঞ্চের নীচে বসে রয়েছেন। এটাও শেখার। তৃণমূল বা কংগ্রেসের কোনও সভায় এই শৃঙ্খলা দেখা যায় না। ওই দুই দলের কোনও সভা, সমাবেশ হলে নেতা, তস্য নেতার ভিড়ে মঞ্চ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ৭ জানুয়ারি সিপিএমের যুব ফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশ দেখে মিডিয়া পণ্ডিতরা ভেবে বসলেন, সিপিএমের পালে হাওয়া লেগেছে। সিপিএমের নেতারাও উল্লসিত হলেন সমাবেশের মেজাজ দেখে। দেড় মাসের মধ্যে সেই মেজাজ উধাও? যে সন্দেশখালিকে সামনে রেখে সিপিএম তেড়েফুঁড়ে উঠতে পারত, সেই সন্দেশখালি নিয়ে তাদের তেমন সক্রিয় দেখা গেল না।

বিজেপি এই ইস্যুতে রাস্তায় আছে বটে, কিন্তু তাদের ব্যাপারটা আবার প্রচারসর্বস্ব। দলের কোন নেতা কখন সন্দেশখালি যাবেন, তা কারও জানতে বাকি থাকে না। তাদের মিডিয়া সেল অবশ্য এইসব ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। তাই বিজেপি নেতাদের পিছনে মিডিয়ার ভিড় লেগেই থাকে। সুকান্ত মজুমদার, শুভেন্দু অধিকারীরা গত ক’দিনে যতবার সন্দেশখালিমুখো হয়েছেন, ততবারই তাঁদের সঙ্গে মিডিয়াকে দেখা গিয়েছে। বিজেপি আবার সন্দেশখালির নারী নির্যাতনকে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের রাজনীতি বানিয়ে ছেড়েছে। শুভেন্দুরা প্রথম থেকে বলে আসছেন, সন্দেশখালিতে হিন্দু জাগরণ ঘটেছে। মঙ্গলবারই আসানসোলে বিজেপির এক বিক্ষোভ সভায় দলের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলকে বলতে শুনলাম, সন্দেশখালিতে নাকি বেছে বেছে হিন্দু মহিলাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে। এটা যে হিন্দু-মুসলমানের বিষয় নয়, গরিব মানুষের বাঁচা-মরার লড়াই, সেটা বিজেপি হয় বুঝছে না, নতুবা বুঝেও  ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু-মুসলিম তাস খেলে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।

এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিতে পারত সিপিএম। তেভাগা আন্দোলনের আঁতুড় হল সন্দেশখালি। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল কমিউনিস্টদের হাতে। হেমন্ত ঘোষাল, কংসারি হালদার, ইলা মিত্রদের মতো কমিউনিস্ট নেতা-নেত্রীরা সেই আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন। জমিদার, জোতদারদের লেঠেলবাহিনীর হাতে কতজন শহিদ হয়েছেন। লোকসভা ভোটের মুখে সন্দেশখালি বামেদের বড় ডিভিডেন্ড দিতে পারত। কিন্তু সেই সুযোগ তারা হেলায় হারাতে বসেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, সিপিএম কি কোনও দ্বিধায় ভুগছে? বাংলায় লোকসভা ভোটে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে জোট আদৌ হবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। হাইকমান্ড অধীর চৌধুরীদের আপত্তি উপেক্ষা করে তৃণমূলের সঙ্গেই শেষপর্যন্ত সমঝোতা করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় এখনও কাটেনি। তাই সিপিএম এখনও কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

 সিপিএমকে বামফ্রন্টের অন্য শরিকদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে আসন নিয়ে। আরএসপি, ফব, সিপিআইয়েরও দাবি রয়েছে। এই শরিকদের হাল খুবই খারাপ। সিপিএম তবু এর মধ্যেও একা ব্রিগেড সমাবেশ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বাকি শরিকদের ব্রিগেড তো দূরস্থান, শহিদ মিনার ময়দানও নয়, এমনকি ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলও  একা ভরার ক্ষমতা নেই। তবু বৃহত্তর বাম ঐক্যের স্বার্থে শরিকদের নিয়ে চলতে হয়। রাজ্যে পালাবদলের পর ১৩ বছর হয়ে গেল, এখনও কিন্তু বামফ্রন্ট টিকে রয়েছে।

লোকসভা ভোটে সিপিএম বা অন্য ফ্রন্ট শরিকরা ক’টা আসন পাবে কিংবা একটাও আসন পাবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে সন্দেশখালি কাণ্ডের সুযোগের কতটা সদ্ব্যবহার তারা করতে পারবে, তা একটা বড় প্রশ্ন। আজ থেকে ৭৮ বছর আগে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই সন্দেশখালি। তার নেতৃত্ব দিয়েছেন কমিউনিস্টরা। তখন তাঁদের লড়াই ছিল জমিদার, জোতদারদের বিরুদ্ধে। আজ বিভিন্ন গ্রামের মহিলাদের লড়াই জমি দখলদারদের বিরুদ্ধে। এই দখলদারি চলছে শাসকদলের মদতে। লোকসভা ভোটের মুখে সন্দেশখালির এই আন্দোলন যে তৃণমূলকে বেশ কিছুটা ব্যাকফুটে নিয়ে গিয়েছে, তা শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীদের আচরণেই পরিষ্কার। মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় দাবি করেছিলেন, সন্দেশখালিতে তেমন কিছু হয়নি। তিলকে তাল করা হচ্ছে। বাম জমানায় এই একই কথা বলতেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। যদি কিছু নাই হবে, তাহলে কেন রোজ শাসকদলের নেতা, মন্ত্রী, পুলিশকর্তারা সন্দেশখালি যাচ্ছেন? কেন পুলিশ গ্রামের মানুষের অভিযোগ শোনার জন্য ক্যাম্প বসিয়েছে? এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই শাসকদলের কাছে। কিছু একটা হয়েছে বলেই তো মুখ্যমন্ত্রী সেখানে যেতে ভয় পাচ্ছেন। যে মমতা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন কোথাও কিছু হলেই ছুটে যেতেন, সেই বিরোধী নেত্রী আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সন্দেশখালিতে যেতে পারছেন না কেন? আমজনতা তা জানতে চায়।

এখন প্রশ্ন হল, বামেরা এই পরিস্থিতির ফায়দা কতটা নিতে পারবে?

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Accident | ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা, গুরুতর আহত তিন

0
কুমারগঞ্জ: ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটল। সোমবার রাত আটটা নাগাদ কুমারগঞ্জ থানার জাখিরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তুলোট মোড় এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন তিনজন।...

Cyclone | চলতি মাসে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বাংলায়

0
শিলিগুড়ি: চার বছরের ব্যবধানে ফের কি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়তে চলেছে বাংলা? বঙ্গোপসাগরে একটি সিস্টেম তৈরি হতে থাকায়, এই আশঙ্কা করছেন আবহবিদরা। তার মধ্যে...

Bagdogra | লোয়ার বাগডোগরায় অবৈধভাবে চলছে ক্র্যাশার, নীরব প্রশাসন

0
খোকন সাহা, বাগডোগরা, ১৩ মে : একদিকে নদী লুট, অন্যদিকে সেই লুটের বোল্ডার দিয়ে অবৈধভাবে চলছে ক্র্যাশার। সরকারি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এমনটাই চলছে...

Siliguri | সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডের গাছ অন্যত্র প্রতিস্থাপনে পরিবেশ কমিটির বৈঠক

0
শিলিগুড়ি: শিলিগুড়ির সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডে রাস্তা সম্প্রসারনের জন্যে ১৭৯টি গাছ অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। গাছগুলি কোথায় স্থানান্তর করা হবে তা নিশ্চিত করতে...

Siliguri | ডেঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম সতর্কতা পুরনিগমের

0
শিলিগুড়ি: ডেঙ্গি পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবার শহরের সমস্ত সরকারি হাউজিং কমপ্লেক্স, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তর পরিষ্কার করবে শিলিগুড়ি পুরনিগম। একবার পুরনিগম পরিষ্কার করে দেওয়ার পর...

Most Popular