Saturday, May 11, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়ন্যায় যাত্রায় রাহুলের প্রাপ্তিযোগ

ন্যায় যাত্রায় রাহুলের প্রাপ্তিযোগ

  • যোগেন্দ্র যাদব

ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার প্রতি গণমাধ্যমের মনোযোগের অভাবের কারণ খুঁজতে খুব বেশি তলিয়ে ভাবার দরকার নেই। তবে লোকসভা ভোটের প্রেক্ষাপটে প্রভাবের নিরিখে এই যাত্রাকে সফল বলা যেতেই পারে। বস্তুত ভারত জোড়ো যাত্রার এই দ্বিতীয় সংস্করণটি কি নিঃশব্দে এমন কিছু অর্জন করেছে যেটি প্রথম যাত্রায় ঘটেনি? মুম্বই থেকে ফেরার পথে নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করেছিলাম। দেশের আর্থিক রাজধানীতে ১৭ মার্চ যাত্রার সমাপ্তি ঘটেছিল। এতে সন্দেহ নেই যে রাহুল গান্ধির ২টি যাত্রাই স্থানীয় স্তরে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে। প্রথম যাত্রার মতো দ্বিতীয়টির দুর্দান্ত সাফল্যের পিছনে যে উপাদান অনুঘটকের কাজ করেছে তা হল কংগ্রেসের স্থানীয়, রাজ্য এবং জাতীয় নেতৃত্বের উপস্থিতিতে খোদ রাহুল গান্ধির ৬,৭০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া। যাত্রা চলাকালীন বিরাট বিরাট জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল, যার অন্যতম হল শিবাজি পার্কে ইন্ডিয়া জোটের মেগা জনসভাটি।

প্রথম যাত্রার মতো এবারেও বহু ইতিবাচক মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। মণিপুরে কুকি মহিলাদের চোখমুখে আশার আলো দেখেছি। মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডের গ্রামে যে দলিত মহিলারা আজও খালি পায়ে হাঁটতে বাধ্য হন, তাঁদের জন্য চটির ব্যবস্থা করেন রাহুল। নানা জায়গায় স্থানীয়দের আবেগময় অভ্যর্থনার কথা মনে থাকবে। কত সুন্দর মুহূর্ত যে ক্যামেরাবন্দি হয়েছে তা গুণে শেষ করা যাবে না। তারপরেও মোটের ওপর যাত্রাটি মূলস্রোতের মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়নি। বিকল্প মাধ্যমগুলিও গতবারের মতো উচ্ছ্বসিত ছিল না। এই অমনোযোগিতার কারণ খুঁজতে গিয়ে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উদ্ভাবনের প্রয়োজন পড়ে না। কখনোই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রথমের মতো উত্তেজনাপূর্ণ হয় না। ভারত জোড়ো যাত্রা খুব চড়া দরের প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। তাই পদযাত্রার বিপরীতে এবার বাহনে সওয়ার হওয়া কোনওভাবেই বাড়তি উন্মাদনা তৈরি করতে পারেনি। এছাড়া ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা যখন হয়েছে তখন লোকসভা ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। কিছুদিন আগে হওয়া একাধিক রাজ্যে হতাশাজনক নির্বাচনি রায়ও যাত্রার আয়োজনের ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া ইন্ডিয়া জোটের শরিক হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসের নিজের উদ্যোগে একটি যাত্রা সংগঠিত করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পশ্চিমবঙ্গে যাত্রাকালে যার প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছে। আখেরে যা বিরোধী জোটের ঐক্য নিয়ে খুব ভালো বিজ্ঞাপন তৈরি করেনি। তারপরেও এর থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি ঘটেছে।

প্রথম পর্বের ভারত জোড়ো যাত্রার মূল্যায়ন করতে গিয়ে দিলীপ ডি’সুজা তাঁর লেখায় নিম্নলিখিত ৩টি উপাদানের কথা স্মরণ করেছেন। এক, মানুষের পাশে দাঁড়ান। দুই, আন্তরিকভাবে মানুষের কথা শুনুন। তাঁদের উদ্বেগের কথা বলুন। সেটা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মহিলাদের সমস্যা, চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি যাই হোক না কেন। তিন, এই জাতীয় সমস্যাগুলি মোকাবিলার জন্য কংগ্রেসের নিজস্ব পরিকল্পনা তৈরি রাখা এবং দেশের স্বার্থে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। ডি’সুজার মূল্যায়ন, কংগ্রেস প্রথম ২টি ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে। তৃতীয়টির জন্য আরও চর্চা প্রয়োজন। তাঁর কাছে, ভারত জোড়ো যাত্রা একটি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। যাঁরা গণতন্ত্রকে বাঁচাতে চান তাঁদের সকলের জন্য এটি এক নতুন আশার জন্ম দিয়েছে।

আমার মতে, ভারত জোড়োর দুই পর্বে ৩টি লাভ হয়েছে। দেশে এক নতুন আশাবাদের সূচনা হয়েছে। ভালোবাসার নতুন ভাষা শিক্ষা এবং শাসক-ঘনিষ্ঠ পুঁজিবাদীদের নাম নেওয়ার সাহস সঞ্চয় করেছে বিরোধীরা। কংগ্রেস পার্টিতে জোড়া যাত্রার সুফল হচ্ছে, কর্মীরা সক্রিয় হওয়ার একটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন। নেতাদের ওপর তাঁদের আস্থা বেড়েছে। এটি রাহুল গান্ধিকে পাপ্পু ভাবমূর্তি ঝেড়ে ফেলে একজন ওজনদার নেতায় পরিণত করেছে। এই যাত্রার মাধ্যমে উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর প্রাপ্তি ‘অর্জন’-এ পরিণত হয়েছে।

সার্বিক ব্যাখ্যায় এটা বলাই যায় যে, এই যাত্রা নিদেনপক্ষে দিল্লিতে বসে বৈঠক করার চেয়ে অনেক বেশি ফলদায়ী। ভারত জোড়ো যাত্রা এবং ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা কংগ্রেসের রাজ্যওয়াড়ি সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে যে সাহায্য করেছে তার প্রমাণ আগামীদিনে পাওয়া যাবে। তবে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ হিসাবে লেখা যেতেই পারে, ‘সভা বা মিছিলে ভিড় নির্বাচনি সাফল্যের সূচক নয়’। রাহুল গান্ধির যাত্রা জওহরলাল নেহরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ার নিজস্ব সংস্করণ। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলির সঙ্গে রাহুলের সম্পৃক্ততা আরও গভীর হয়েছে। তিনি জনসংযোগের নিজস্ব শৈলী গড়ে তুলেছেন, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত ক্যারিশমাকে টক্কর দিতে পারে।

এগুলি রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আগ্রহের বিষয়। যাত্রার মূল্যায়নের ভিত্তি নয়। দ্বিতীয় ভারত জোড়ো যাত্রার আসল সাফল্য যখন ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রার সূচনা হয়েছিল আমি সমসাময়িক কলামগুলিতে লিখেছিলাম, এই যাত্রাটি বিজেপি-আরএসএসের আদর্শগত আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। বিরোধীদের আদর্শগত লড়াইয়ে জয়ী হতে হবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে সাংবিধানিক আদর্শগুলিকে তুলে ধরতে হবে। বিরোধীদের জাতীয়তাবাদের উত্তরাধিকার পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরাই ভারতীয় সভ্যতা ও ঐতিহ্যের সেরা উত্তরাধিকারী। যাঁরা আমাদের প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর তাঁদের অবশ্যই আদর্শগত বৈচিত্র্যময়তাকে পুনরুদ্ধার এবং নতুন করে সংজ্ঞা দান করতে হবে।  এটা রাতারাতি হবে না। আমাদের কোনও অলৌকিক আশাবাদে বিশ্বাসী হওয়া অনুচিত। কিন্তু খুব দ্রুত পথ চলা শুরু করতে হবে। এই যাত্রার আসল সাফল্য হচ্ছে একাধিক উপায়ে আধিপত্যবাদী রাজনীতির পালটা ধারণাকে গতিশীল করা।

প্রথমত, এটি এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেখানে বিরোধীদের সিংহভাগ বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনীতির ফলে চাপে পড়েছে। সেদিক থেকে রাহুল গান্ধির যাত্রা ধর্ম, বিশেষ করে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণজনিত উন্মাদনা থেকে নীতিগত দূরত্ব তৈরি করে সাংবিধানিক আদর্শের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত রয়েছে। বস্তুতপক্ষে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসকে ত্যাগ না করে রাহুল গান্ধি একটি আপসহীন ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, তাঁর ‘মহব্বত’ (ভালোবাসা)-এর বার্তা ন্যায়বিচারের প্রতি একটি সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারে পরিণত হয়েছে। বার্তাটি স্পষ্ট। অন্যায়ের মধ্যে ঘৃণার রাজনীতি মিশে রয়েছে। এই যাত্রা রাষ্ট্রীয় হিংসা, জাতপাতের অবিচার, লিঙ্গ নিপীড়ন, আঞ্চলিক অবহেলা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং অন্যায়ের শিকারদের কথা তুলে ধরতে পেরেছে। প্রথম যাত্রাটি যদি শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুঁজিবাদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের রাস্তা তৈরি করে থাকে তাহলে দ্বিতীয় পর্বে তা খোলামেলা সমালোচনার রূপ ধারণ করতে পেরেছে।

তৃতীয়ত, যাত্রাটি ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতিকে ৫টি মাত্রা যুক্ত রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডায় পরিণত করেছে। সমাজের ৫টি গোষ্ঠী (যুব, নারী, কৃষক, শ্রমিক এবং প্রান্তিক শ্রেণি), যাঁরা অবিচারের শিকার প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট গ্যারান্টির কথা বলে। যেমন- শিক্ষানবিশ হিসাবে এক বছরের বেতন পাওয়ার অধিকার, সরকারি চাকরিতে মহিলাদের ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ, ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের আইনি স্বীকৃতি, শহুরে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং জাতিগত সমীক্ষা। ইতিমধ্যে বিজেপি এই দাবিগুলির কয়েকটিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে।

সব শেষে বলা যায়, রাহুল গান্ধির যাত্রা দেশের প্রধান বিরোধী দলকে তার নিজস্ব সামাজিক গণভিত্তির দিকে দৃঢ়ভাবে চালিত করেছে। যেটি হল ভারতীয় পিরামিডের নীচের অংশ। এটা প্রথম ধাপ মাত্র। কংগ্রেসের পক্ষে নিজের সামাজিক গণভিত্তি পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে না। সবার আগে সংগঠন ও নেতৃত্বকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই উদ্যোগে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, যাঁদের স্বার্থে আঘাত লাগবে তাঁরা দ্রুত প্রতিশোধ নিতে তৎপর হতে পারেন। তবে বর্তমান আধিপত্যবাদী রাজনীতির মোকাবিলায় এটা ছাড়া পথ নেই। ভারত জোড়ার এই ন্যায় যাত্রা তো সবে শুরু হয়েছে।

(লেখক সেফোলজিস্ট, রাজনীতিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Panchanan Barma | রেজিস্ট্রার সাসপেন্ড হতেই দিনভর নাটকীয়তা পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে স্থগিতাদেশ রাজ্যের

0
কোচবিহারঃ কোচবিহার পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারের দ্বন্দ্ব কিছুতেই মিটছে না। এ যেন অনেকটা রাজ্য-রাজ্যপালের সংঘাতের মতো। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী রেজিস্ট্রারকে সাসপেন্ড করলেন...

Accident | গাড়ির ধাক্কায় পথচারীর মৃত্যু, প্রতিবাদে রাজ্যসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ গয়েরকাটায়

0
গয়েরকাটাঃ শুক্রবার রাত নটা নাগাদ গয়েরকাটা বানারহাট রাজ্য সড়কের উপর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির। মৃত ব্যক্তির নাম সন্তোষ মাহালি (৪২)। বাড়ি গয়েরকাটা চা...

FIR against dowry | ৪০ দিনে দায়ের ১০ অভিযোগ, পণের দাবিতে অত্যাচারের বাড়বাড়ন্ত শিলিগুড়িতে

0
শিলিগুড়ি: শহর আধুনিক হয়েছে। তবে পণ প্রথা কি দূর হয়েছে? উত্তরটা বোধহয় ‘না’। শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন পুলিশের মহিলা থানায় শুধুমাত্র ১ এপ্রিল থেকে থেকে ১০...

Arrest warrant | বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও ভারতের ভোটার! নথি দেখেই চোখ কপালে পুলিশের

0
রায়গঞ্জঃ বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও বর্তমানে ভারতের নাগরিক। রয়েছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, র‍্যাশন কার্ড এমনকী রয়েছে জন্মের প্রমানপত্র। এমনই যুবক ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে...

Brij Bhushan Sharan Singh | বিপাকে ব্রিজভূষণ, প্রমাণ মেলায় যৌন হেনস্তার অভিযোগে চার্জ গঠনের...

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: বড় ধাক্কা খেলেন যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং। তার বিরুদ্ধ যথেষ্ট প্রমাণ মেলায় চার্জ গঠনের নির্দেশ দিয়েছে...

Most Popular