- রুদ্র সান্যাল
মানুষের জীবনে কখন কী ঘটে যায়, সেই হিসেব আমরা কেউই বুঝতে পারি না। বিশেষ করে মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে আমাদের। বৃহস্পতিবারই উত্তরবঙ্গ সংবাদে খবর বেরিয়েছে, সেবক ব্রিজের কাছে দুজন ঝাঁপ দিয়েছেন তিস্তায়। কয়েকদিন আগে আমাদের পরিচিত সচ্ছল চাকরিজীবী মধ্যবয়স্ক মানুষ যখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন সবাইকে চমকে।
আসলে আত্মহত্যা এই মুহূর্তে শুধু তরুণ প্রজন্মকেই গ্রাস করছে না, বয়স্ক এবং মধ্যবয়স্ক মানুষকেও গ্রাস করছে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল জার্নালে বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর অন্যতম মহামারি হল আত্মহত্যা।
তবে এটা চরম সত্য যে, বেশিরভাগ আত্মহননকারী মানুষের বেশিরভাগ মানসিক সমস্যা থেকে তৈরি হয় অবসাদ। ৩০ থেকে ৭০% আত্মহননকারী ব্যক্তির মধ্যেই থাকে অবসাদ অথবা বাইপোলার ডিজঅর্ডার।
অনেক হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি দুর্বল মুহূর্তে বলে ফেলেন, ‘এ আর নতুন কী? মৃত্যুর পর সবাই আফসোস করে। হয়তো আমাকে নিয়েও করবে। মৃত্যুই বোধহয় মুক্তি!’ কিন্তু সত্যিই কি মুক্তি? তাঁর সঙ্গে যাঁরা জড়িত থাকেন তাঁদের তো কোনও মুক্তি হয় না। প্রশ্ন তো উঠবেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেন্টিং সুইসাইড: এ সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’-র সমীক্ষা বলছে, ‘প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি।’ আরও একটি সমীক্ষা বলছে, ‘গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে আত্মহত্যা! কতটা জটিল মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে আমাদের সমাজ।
এটা শুধু ভারত বা উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশগুলিতেই সীমাবদ্ধ নেই। উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেও মানুষ এই মানসিক হতাশার মধ্যে দিয়ে নিজেকে আত্মহনন করেই চলেছে। এক নীরব মহামারি ঘটেই চলেছে আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত।
ইতালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস একবার বলেছিলেন, ‘আত্মহত্যা করার জন্য কারও কোনও কারণের অভাব হয় না।’ এটাই হল সবচেয়ে নির্মম সত্যি কথা। মার্কিন লেখক এডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেন, ‘যখন কেউ উপলব্ধি করে, তার জীবনের কোনও মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যা করে নয়তো ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনও মানুষের জীবনই মূল্যহীন বা অর্থহীন হতে পারে না। তবু কেউ যদি তা মনে করেন, আমি চাইব, আত্মহত্যার পরিবর্তে তিনি ভ্রমণকেই বেছে নেবেন।’
আত্মহত্যার বদলে ভ্রমণকে বেছে নেওয়াই যায়। আসল কথা, কাউন্সেলিং করেও অনেক মানসিক সমস্যার সমাধান করা গিয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও প্রবণতা যদি থাকে নিজেকে শেষ করার, তাহলে কোনও কাউন্সেলিং তাকে সেই প্রবণতা থেকে আটকাতে পারবে না। এটাই বাস্তব।
আসলে ডিপ্রেশনকে অবহেলা না করে, কাউন্সেলিং করানো দরকার। আমাদের বহুদিনের সাধারণ ধারণা, মানসিক স্বাস্থ্যের কাউন্সেলিং মানে পাগলের চিকিৎসা। এই ধরনের অপধারণাই আমাদের শরীর এবং মনে নীরবে বাড়িয়ে তোলে অবসাদ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা। তাই সঠিক মানসিক চিকিৎসা প্রথমেই করা দরকার। জীবন একটাই। তাই তাকে উপভোগ করে বেঁচে থাকাই হল প্রকৃত জীবনের নাম।
(লেখক বিধাননগরের স্কুলের শিক্ষক)