সপ্তর্ষি সরকার, ধূপগুড়ি: আধুনিক জীবনযাত্রায় কুমোরপাড়ার প্রয়োজন ফুরোচ্ছে দিন-দিন। মাটির কলসি, হাঁড়ি গোরুর গাড়িতে বোঝাই করে হাটে পসরা সাজাতে যাওয়ার দিন এখন আর সেভাবে দেখা যায় না। পেটের দায়ে পেশা বদলাতে হয়েছে কুমোরদের (Potters) বর্তমান প্রজন্মকে। তবে লড়াই যেন শেষ হয়েও হয়নি। কুমোররা ঝুঁকেছেন ডিজাইনার চায়ের ভাঁড়ে। বাজারের চাহিদাজাত পেশায় ফেরাচ্ছে কুমোরদের।
ধূপগুড়ি (Dhupguri) শহরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর ব্রিজ সংলগ্ন গোবিন্দপল্লি এলাকায় কয়েকটি কুমোর পরিবারে নতুন করে আশা জাগাচ্ছে মাটির ভাঁড়। সেই ভাঁড় যাচ্ছে কোচবিহার (Coochbehar) থেকে উত্তর দিনাজপুরের (Uttar Dinajpur) বেশ কয়েকটি জায়গায়। একসময় পৈতৃক পেশা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে গয়না কারিগরের পেশায় ঝুঁকে যাওয়া গোপাল পাল, পঞ্চু পালরা এই মাটির ভাঁড়কে সম্বল করেই ফের পারিবারির পেশার টানে ফিরেছেন। গোপালের কথায়, ‘ছোট থেকেই বাবা-ঠাকুরদাকে যে কাজ করতে দেখেছি, সেটা করতে কে না চাইবে। হাঁড়ি-কলসি বানিয়ে পরিবারের পেট ভরানো মুশকিল। তবে চায়ের ভাঁড় নতুন করে আশা জাগিয়েছে আমাদের।’
কলকাতায় বরাবরই মাটির ভাঁড়ে চা দেওয়ার চল রয়েছে। তবে উত্তরবঙ্গে এখনও সেভাবে জিনিসটি প্রচলিত নয়। শুরুতে কিছু এলিট চায়ের স্টলে মাঁটির ভাঁড় দেখা যেত। তবে বর্তমানে উত্তরেও পথের পাশের চায়ের ঠেকে দেখা মিলছে ভাঁড়ের। চাহিদা বুঝে বিহার থেকে মেশিন এবং বিভিন্ন মাপের ছাঁচ এনে ভাঁড় তৈরি শুরু করে গোপাল পালের পরিবার। ৫০, ৬০, ৮০ মিলিলিটার সাইজের ভাঁড়গুলি অচিরেই ভালো সাড়া পায় বাজারে। ছোট সাইজের ভাঁড় ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং বড় ভাঁড় ২ টাকা ৫০ পয়সা দরে দেদার বিকোচ্ছে বাজারে। চাহিদা বাড়ায় প্রোডাকশনও বাড়ছে।
এজন্যে বিশেষ মাটি আসছে বিহার-বাংলা সীমানার বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে। প্রথমে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা মাটি ছেনে তা ছাঁচে ফেলে মেশিনের মাধ্যমে ভাঁড়ের রূপ দিচ্ছেন। আধঘণ্টা ছাঁচবন্দি থাকার পর কাঁচা ভাঁড় বের করে রোদে শুকোতে দেওয়া হচ্ছে। পরের ধাপে বাড়ির মহিলারা জিনস জাতীয় খসখসে কিছু দিয়ে সেগুলি পালিশ করে দেন। শুকিয়ে যাওয়ার পর ভাটিতে অন্তত টানা ১২ ঘণ্টা পোড়ানোর পর ভাঁড় তৈরি।
পরিবারে মাটির কাজের চল ফেরায় খুশি ষাটোর্ধ্ব সুরেশ পাল। তাঁর বক্তব্য, ‘বংশপরম্পরায় আমরা এই কাজেই স্বচ্ছন্দ। মাটির জিনিসের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় আমাদের পেশাটাই মুছে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। সেই অর্থে ভাঁড়ের মাধ্যমে পূর্বপুরুষের পেশা বেঁচে থাকলে ভালো লাগবে।’
গৌরী পালের মতো বাড়ির মহিলারাও প্রতিদিন পরম যত্নে নিখুঁত রূপ দেন ভাড়গুলিকে। এ কাজকে তাঁরাও ভালোবেসে ফেলেছেন ক’দিনেই। পারিবারিক নিয়মেই বৈশাখে নতুন ভাঁড় গড়া বন্ধ রয়েছে। তবে কাজ থেমে নেই। এক মাস নতুন কিছু গড়া যাবে না বলে বাজারের চাহিদা মেটাতে আগেভাগে প্রচুর কাঁচা ভাঁড় গড়ে রেখেছেন পুরুষ সদস্যরা। বর্তমানে শুধু পালিশ করে ভাটিতে পোড়ানো হচ্ছে ভাঁড়।
স্থানীয় চায়ের দোকানগুলিতে মাটির ভাঁড়ের কদর বাড়া প্রসঙ্গে ধূপগুড়ি শহরের এক চা বিক্রেতা মানিক অধিকারী বলেন, ‘কাগজের কাপ বেশি চললেও আজকাল বহু মানুষ ভাঁড় পছন্দ করছেন। বাইরে থেকে ভাঁড় কিনে আনতে অনেক বেশি দাম পড়ত। ধূপগুড়িতে ভাঁড় তৈরি হওয়ায় আমরাও লাভবান হয়েছি।’
এখনও ভাঁড়ের চাহিদা তেমন জায়গায় পৌঁছায়নি। তবে চাহিদা যে বাড়ছে তা টের পাচ্ছেন কুমোররা। তাঁরা চাইছেন, অফিস-কাছারি, অলিগলি-রেস্তোরাঁয় চায়ের সেবা হোক মাটির ভাঁড়েই।