Thursday, May 16, 2024
Homeপুজো স্পেশালঅমল মহিমা লয়ে তুমি এলে

অমল মহিমা লয়ে তুমি এলে

                                                              সেবন্তী ঘোষ

ঘরকুনোদেরও দুর্গাপুজোর স্মৃতি থাকে। আর স্মৃতিরও আগে শোনা কথার স্মৃতি থাকে। ডুয়ার্সের অন্য জায়গার কথা বলতে পারব না, কার্শিয়াং ও তিনধারিয়ার পুজোর কথা বাড়িতে সবসময় শুনেছি। কার্শিয়াংয়ে পুজোর কত গল্পকথা! বিজয়া দশমীর অনুষ্ঠানে কতকাল আগে বাড়ির বিবাহিত ও অবিবাহিতাদের অংশগ্রহণের কথা শুনে মনে হয় ব্রাহ্মদের এবং পাহাড়ের অধিবাসীদের খোলা হাওয়ার ঝাপট সেখানকার বাঙালিদেরও প্রভাবিত করেছিল।

১৯৩০ সালে কার্শিয়াংয়ে বর্ধমান রাজার দেওয়া জমিতে রাজরাজেশ্বরী হল তৈরি হয়। রায়বাহাদুর শশীভূষণ দে, যাঁর তৈরি স্যানাটোরিয়াম একদা ভারতের উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যনিবাস, তিনি তাঁর স্ত্রীর নামে এই হলটি তৈরি করেন। সেকালের আরও দশটা পুজোর মতো আড়ম্বর ও আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতাহীন, প্রতিমার নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্যের বদলে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা নিয়ে পুজো হত। এখানকার দুর্গাপুজোর ভোগ স্যানাটোরিয়ামের রোগীদের জন্য যেত। বিসর্জন হত নদীর বদলে হোসেন খোলায়। এই পুজোর বিষয়ে উনিশশো বিয়াল্লিশের পরবর্তী এক স্মৃতিচারণায় শারদ উৎসবে মেয়েদের অংশগ্রহণের কথা পড়া য়ায়।

মেয়েদের বসার জায়গা দোতলায়। এখনকার মতো নীচে নয়। তবে আরতি ও অঞ্জলির সময় মেয়েরা নীচে। তাও মেয়ে পুরুষের মাঝে একটা সীমারেখা… প্রাথমিক স্কুল ঘরে মহিলারা তরকারি কাটতেন। এখনকার মতোই নৈবেদ্য পূজা উপচার গোছাতেন মহিলারা- সঙ্গে ছোট মেয়েরা। সপ্তমী থেকে নবমী ভোগ প্রায় সব বাড়ির প্রসাদ নেওয়া। ভাঁড়ারে টিফিন ক্যারিয়ারের ভিড়। অনেক বয়স্কা পুজোর কদিন মায়ে ভোগ খেয়ে শুদ্ধাচারে থাকতেন। …ভোগের রান্নায় পুরোহিতের কাজে ও দেবী স্নানের সময় পুরুষ থাকলেও বয়স্কাদের সাহায্যে ছোট মেয়েরা নৈবেদ্য সাজানোর ফল কাটায় ব্যস্ত থাকত। স্টেজে ওঠার সিঁড়ির ধারে তক্তপোশ ফরাস পাতা। বয়স্ক বৃদ্ধারা বসা। ওই অতকাল আগে বারোয়ারি পুজোয় নবমীর শেষে আরতির জন্য পুরুষদের সঙ্গে মেয়েও যোগ দিতেন।

মহালয়ার দিন ভোরে শিলিগুড়িতে প্রতিমা আনতে যাওয়া আর পুজোর উপকরণ সহ প্রতিমা নিয়ে ফিরতে কখনও রাত ১২টাও হয়ে যাওয়া সহ পাহাড়ি পথের ট্রাকের মধ্যে বালি বিছিয়ে ওই ভারী প্রতিমা ধরে বসে আসার মতো কষ্টসাধ্যের কথাও পাই। আরও বেশ চিত্তাকর্ষক বিবরণ আছে। কয়েকবার পুজোর সময় ছিল খুব সকালে। রাত তিনটার সময় বসাক মাস্টারমশাই একা হাতে লণ্ঠন, অন্য হাতে লাঠি মুখে হরিনাম। চলেছেন নয়া কামান রেল কলোনি থেকে রাজেশ্বরী হল। মহিলাদের রক্ষক হয়ে পুজোমণ্ডপে। অত রাত্রে মেয়ে আসবেন একা একা। তা কি হয়? (স্মৃতির মালিকা, কল্যাণী হালদার)

তিনধারিয়ায় মূলত রেল কর্মচারীদের উদ্যোগে ব্রহ্মমন্দির উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উলটো দিকের মাঠে দুর্গাপুজো হত। ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছেই মৃৎশিল্পী বিজয় পাল ও তাঁর ভাগ্নে দেবেন পাল গিয়ে উঠতেন। শিলিগুড়ি থেকে পুরোহিত নিয়ে য়াওয়া হত। পুজোর ব্যবস্থাপনার পুরোভাগে ছিলেন আমার ঠাকুমা। এই দেবেন পাল পরবর্তীকালে শিলিগুড়ির অন্যতম মৃৎশিল্পী হয়েছিলেন।

শৈশবে আমার পুজোর আকর্ষণ ছিল শারদ পত্রিকা আর কদিন স্কুলের পড়া থেকে রেহাই। যখন মন চায় গল্পের বই পড়া আর নতুন পোশাকটি পরে বিকেলের পুজো প্রাঙ্গণে নিজেকে খানিক দর্শনধারী করারও সুপ্ত ইচ্ছে ছিল। কাশ নয়, শরতের আগমন বার্তা হিসেবে বাতাসে নাক টানলে পাহাড় থেকে ঝপ করে নেমে আসত একটা হিমেল ঠান্ডা হাওয়া। অবধারিতভাবে সমতলের শিউলি গন্ধ মিশে যেত তাতে। শহরের দুদশটা দোকান যাদের সঙ্গে খরিদ্দারদের সম্পর্ক প্রায় পারিবারিক, সেখান থেকে মায়ের সিল্কের শাড়ি, দুই বোনের একই রকম সিল্কের উপর প্রিন্ট জামার কাপড় চলে এসেছে। পাড়ায় পাড়ায় তখন টেলারদের রমরমা। রেডিমেড বিষয়টা বেশ হেলাফেলার ছিল। সেইসব বিউটি, কানন টেলার্সে ডিজাইনের বই দেখে দুটো ফ্রকের অর্ডার দিয়ে তা হাতে পাওয়ার জন্য উত্তেজনার অপেক্ষা শুরু হয়ে যেত।

প্রথমদিকে আমাদের পাড়া বাঘা যতীন পার্কে কোনও পুজো ছিল না। কলেজপাড়ার পুজোয় যেতে হত। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার অন্দরমহলের দায়িত্বে স্থানীয় মহিলারা থাকতেন। আমাদের এদিক থেকে যাঁরা য়েতেন তাঁদের ভোগ দিতে অপেক্ষা করতে হত বা তাঁরা বেশ খানিকটা অস্বস্তিতে থাকতেন। এরপরে পাড়ার বয়স্কদের উদ্যোগে বাঘা যতীন পার্কের পুজো শুরু হয়। চাঁদা তোলা থেকে পরিকল্পনা, ঠাকুরের অর্ডার, বাজার, অষ্টমী নবমীর খাওয়াদাওয়ার হিসেব, পুরোহিত পুরুষদের দখলে ছিল কিন্তু মেয়েই শক্তিরূপিণীর আসল ভরকেন্দ্র। দুর্গাপুজো মানে তো যজ্ঞিবাড়ির আয়োজন। সবকিছুই সেখানে বিপুল পরিমাণ, সময়সাপেক্ষ। মাঝরাতে পুজোর সময়ে থাকাই হোক বা কাকভোরে, পাড়ার মেয়েই সবকিছু গোছগাছ করে পুরোহিতের সঙ্গে বসে পড়তেন।

একান্তভাবে মেয়েদের উদ্যোগে পুজো আমি অন্তত শৈশবে দেখিনি। তবে একজন মহিলা পুরোহিতের কথা শোনা যেত যিনি দুর্গাপুজো করতেন। সেসময় বাজারের ফুল অপ্রতুল। ফলে ভোরবেলা এর বাড়ির শিউলিতলা ওর বাড়ির গলির স্থলপদ্ম সংগ্রহ শুরু হয়ে যেত। পাড়ার কুচোরা, যাদের মধ্যে একটা-দুটো বালক বা কিশোরকে দেখা যেত কিন্তু তারা আসলে ছিল বালিকা বা কিশোরী দলের কারও ভাই, যে দিদিদের তাড়নায় ডাল বেঁকিয়ে ফুল পাড়ার কাজে বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত হত। শৈশবের পুজোয় এই যে তদ্গত ও অনাড়ম্বর ছবি আমরা ফেলে এসেছি বলে মনে করি তা এখনও আছে, শুধু স্থান পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।

কয়েক বছর আগে উত্তরবঙ্গ সংবাদের তরফে পুজো পরিক্রমায় গিয়েছিলাম। খড়িবাড়ির কাছাকাছি যখন পেঁছোলাম, তখন প্রায় রাত বারোটা। খোলা মাঠের ভেজা শিশির মেশা কাদা পেরিয়ে মূল মণ্ডপের কাছে পৌঁছোলাম। বিরাট মাঠের দূরে দূরে টিনের চালের বাড়িগুলিতে স্তিমিত হলুদ আলো। সাধারণ এক মণ্ডপে একচালায় দেবীর মুখ ঝকঝক করছে। তাঁর পায়ের সামনে সিঁড়ির ধাপে বাচ্চাকাচ্চা সহ মেয়ে, কিশোরী ও বয়স্করা সন্ধিপুজোর অপেক্ষায় কেউ বা ঢুলে পড়ছেন। কেউ মাড়ের গন্ধ ওঠা ফুলে ওঠা সুতির শাড়ি জড়িয়ে মড়িয়ে ঠাকুরমশাইকে সাহায্য করছেন। দৃশ্যটি ঠিক আমার শৈশবের মতো। হঠাৎ মনে হল ইহজন্মে বড়জোর আর পঁচিশটা শরৎ দেখতে পাব। কেন যে তাকে হেলাফেলায় ঘরকুনো হয়ে এড়িয়ে গেলাম!

দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দুর চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বৃহত্তর জনসমাজে সাদরে গৃহীত হয়েছে। বহু পেশার মানুষ এই উন্মুক্ত শিল্পোৎসবে যুক্ত থাকেন। সংবৎসরের রোজগারের একটা বড় অংশ এই সময় সংগৃহীত হয়, ঢাকিরা আসেন, আসে পদ্ম ফুলের জোগানদার, থিম পুজোর নির্দেশক শিল্পী ও তাদের সাধারণ কারিগর ব্যস্ত হয়, ডেকোরেটারের বাঁশের জোগান বাড়ে। এমন হরেক বিভাগে দুর্গাপুজো ছড়িয়ে থাকে। আলোর সজ্জা ও শিল্পীর চমকপ্রদ কাজ দেখতে ভিন্নধর্মীরও বিশেষ অসুবিধা হয় না। যে ডাকের সাজের এত ঐতিহ্যের গৌরব সেও যে ইংরেজ আমলে পোস্ট বা সাগরপার থেকে জাহাজ ডাকে আসা শোলার অবদান তাই বা শৈশবে কে জানত? ঢাকের চামড়া কোন জন্তুর, বা ঢাকির ধর্ম কী, তাই নিয়ে বা কারই বা মাথাব্যথা ছিল?

দানবরূপী অশুভ মদমত্ত স্পর্ধা দমন করতে যে দেবী মর্তে আবির্ভত হন, যিনি সালংকারা ও অস্ত্র শোভিত, জ্ঞানাবধি বঞ্চিত, নিষেধের বেড়াজালে সংকুচিত জীবন সাধারণ মেয়ে তাঁর সঙ্গে একাত্মবোধ করে। সংসারে প্রতিবেশে যে অসুর দলন করতে পারেনি, শুনে ও দেখে এসেছে কন্যাসন্তান হওয়ায় তার সমাজে হাজারো প্রতিবন্ধকতা, সেও ক্ষমতাময়ী দেবীর জন্য মনে মনে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে। বিশেষত যে দেবী ছোট্ট করে মাথার ওপর শ্মশানে মশানে ঘোরা বহুপত্নীক স্বামীকে ঠাঁই দিলেও, তাঁদের মতোই যুদ্ধের ময়দানে এসেও সন্তানদের হাত ধরে রেখেছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন সমানভাবে।

(লেখক শিলিগুড়ির সাহিত্যিক ও শিক্ষক)

Sucharita Chanda
Sucharita Chandahttps://uttarbangasambad.com/
Sucharita Chanda is working as Sub Editor Since 2020. Presently she is attached with Uttarbanga Sambad. She is involved in Copy Editing, Uploading in website and various social media platforms.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Mamata Banerjee | কপ্টার নামবে মমতার, মাঠ দিল না মন্ত্রীপুত্রের কলেজ, শোরগোল কাঁথিতে  

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ যেই কলেজের মাথা মন্ত্রীপুত্র, সেই কলেজের মাঠেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেলিকপ্টার নামার অনুমতি পেল না। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের অধীন কাঁথিতে দেবাংশু...

Fire arms | ফের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার দিনহাটায়, গত দু’দিনে উদ্ধার তিনটি পিস্তল  

0
দিনহাটা: ফের আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার দিনহাটায়। মঙ্গলবার রাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও তাজা কার্তুজ সহ এক দুষ্কৃতীকে গ্রেপ্তার করলো দিনহাটা থানার পুলিশ।   গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বড়...

Darjeeling | পর্যটকদের জন্য সুখবর! এবার এই নয়া রুটে বাসে করেই পৌঁছে যাবেন দার্জিলিং

0
শিলিগুড়ি: পর্যটকদের অত্যন্ত পছন্দের গন্তব্য পাহাড়ি শহর মিরিক। তবে এতদিন মিরিক পর্যন্ত বাস পরিষেবা থাকলেও সেখান থেকে দার্জিলিং যেতে গেলে ভরসা করতে হত প্রাইভেট...

Theft Case | গভীর ঘুমে বাড়ির সদস্যরা, গয়না-টাকা নিয়ে চম্পট দুষ্কৃতীদের

0
হেমতাবাদ: গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাড়ির সদস্যরা। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কার্যত লুঠতরাজ (Theft case) চালাল একদল দুষ্কৃতী। ঘটনার জেরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে হেমতাবাদে। মঙ্গলবার...

Accident | নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দ্রুত গতিতে গাছে ধাক্কা মারুতি ভ্যানের, মৃত ১, আহত ৬...

0
কিশনগঞ্জঃ বুধবার রাতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে থাকা একটি গাছে ধাক্কা মারল একটি মারুতি গাড়ি। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল এক যাত্রীর। গুরুতর আহত হয় আরও...

Most Popular