বিজয় দে
মা বলতে যাকে বুঝি সে তো একজনই, কাগা-বগার মা। কিন্তু তুমি জোর দিয়ে যখন বললে আমার মা মানে একমাত্র তিনি, তিনি উমা। তাহলে সেটাই সই, এটাই ভেবে নিই। তার মানে, এই পৃথিবীতে মা যে একজন আছেন, সেই মা যারই হোক এটাই তো যথেষ্ট!
প্রতি বছর যেমন হয়, আকাশজুড়ে অজানা দেশের মানচিত্রের মতো সাদা-কালো-হলুদ মেশানো মেঘ…জমা হচ্ছে, জমা হতে থাকে। আর সেই জমানো মেঘ থেকে কদিন পর বৃষ্টি। সেই অঝোর ধারার বৃষ্টি শেষ হলে নীল টুকটুকে আকাশ আর আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা ধবধবে মেঘ। আর প্রকৃতির ঠিক এই সময়, চারিদিকে আকাশ ছাপিয়ে একটা কচিকাঁচা আওয়াজ ওঠে মা আইচ্চে মা আইচ্চে…কাগা-বগার মা আইচ্চে…। এত মজার ডাক, এত উতলা চিৎকার খুব কম শোনা যায়। প্রথম আওয়াজটা থাকে একজনের, সে চিলেকোঠায় ঘাপ্টি মেরে বসে থাকা, একজন আদি তক্ষক। তারপর কে নেই, ভেজা কাঁঠাল গাছে জড়িয়ে থাকা শুঁয়োপোকা থেকে কাশফুলের চারদিকে পিড়িং পিড়িং করে উড়তে থাকা ফড়িং, সবার ভেতরেই একই শিহরণ…মা আইচ্চে মা আইচ্চে, কাগা-বগার মা আইচ্চে…।
তার মানে এক বছর পর আবার কাগা-বগার মা আসছে। কিন্তু মা যায় কোথায়? সে কি কাগা-বগার কাছে চিরদিন থাকতে পারে না? কেন জানি না, প্রশ্নটা শেষ পর্যন্ত তোমার দিকেই চলে গেল। উত্তরে তুমি বললে, আরে এ তো সবই উমা মায়ের কথা। মায়ের সঙ্গে সন্তানের চিরকালের প্রাণের কথা। আমি অবশ্য উমাকে চিনি কিন্তু কাগা-বগার মাকে চিনি না…।
২. কাগা-বগা কি একজন নাকি অনেক? আর আমার মনে এই নিয়ে অনেক ধন্দ। ইতিহাসের পেছন দিকে যেতে যেতে দেখা গেল, আসলে কাগা-বগার শেষ নেই। তাদের বাপ নিয়ে কোনও কথা নেই, কিন্তু পাখির ডানার মতো শান্ত একজন মা আছেন। তারপর কাগা-বগাদের সঙ্গে যতটুকু কথা হয়েছিল, সেটা ঠিক এরকম…।
তোমরা যেভাবে মাকে দ্যাখো, আমরা কিন্তু সেভাবে দেখি না
সেটা কীরকম?
তোমরা মায়ের নামে দেশ-জোড়া আগমনী গান বেঁধেছো, কিন্তু আমাদের মায়ের নামে তো কিছুই নেই। যদিও আমরা শুধু হাওয়ায় হাওয়ায়, বাতাসের ফাঁক দিয়ে ভেসে-আসা এই গান টের পাই। আর আমাদের যেটা কাজ, শরৎকালের মনের কথায় কাশফুলের সুর বসাই, এটাই আমাদের একমাত্র আগমনী। তোমাদের প্রতি আমাদের বিষম রাগ, তোমরা ঢাক বাজিয়ে মাকে ডেকে আনো ঘরে, কিন্তু মায়ের শরীরের পেছনে মাটি দিতে ভুলে যাও। বিজয়া দশমীতে তোমরা মায়ের মুখে জোর করে পান-সন্দেশ গুঁজে দাও। এ তো এক ধরনের সন্ত্রাসও বটে। আর দাঁতে দাঁত চেপে মা তোমাদের অত্যাচার সহ্য করে। কিন্তু তখন তোমাদের চোখ-মুখজুড়ে শুধু সিঁদুরের সধবা অহংকার। তারপর যা হয়, বিসর্জনের দিন এলে, উল্লাস উল্লাস, তোমরা মাকে ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দাও। মায়ে এই কষ্ট, এই অপমান আমরা সহ্য করতে পারি না…
কিন্তু তোমাদের মায়ের বেলায়?
মায়ের আগমন আর বিসর্জন এই দুই সময়ে আমরা মাকে চারদিক থেকে জড়িয়ে ধরি। মায়ের শরীর থেকে গরম নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস আমাদের শরীরে ঢোকে। আমাদের আয়ু বেড়ে যায়। আমরা মায়ের কানের কাছে মুখ রেখে বলি, মা, এভাবে পাহাড় নদী ডিঙিয়ে যাচ্ছ আসছ, তোমার ভয় করে না? মনে রেখো, আর কেউ থাক বা না থাকুক, কাগা-বগারা কিন্তু তোমার সঙ্গে সবসময় আছে।
৩. আর এবার তোমার কথা। তুমি যা বলতে চাও, সেটা একবার শুনি। উমাকে জাগাও। উমাকে বরণ করো। আমাদের স্বপ্নগুলোর অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। উমাকে বাঁচাও। আমাদের বেঁচে-থাকার দিনগুলির অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকার প্রথম ও শেষ অংশ হচ্ছে মা। সন্তানের জীবনের জন্য মাকে বাঁচাও।
আমার কথা, এই পৃথিবী থেকে মায়ের বিদায় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক!
৪. মায়ের চার পাশে যারা ঘুরঘুর করে, আমি কিন্তু তাদের একজন। এদিকে লক্ষ্য করে যাচ্ছি, মায়ের যত কাছাকাছি যাই, ততই মায়ের সঙ্গে যেন দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে।
পাতাবাহার গাছের ঝোপের আড়ালে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু মা কোথায়? মাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।
এই নিয়ে তিনজন তিন রকম কথা বলল। একজন বলল, এই তো তোমার মাকে দেখলাম, সীমান্তে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। আরেকজন বলল তোমার মা, মনে হচ্ছে, অন্ধকারে, নদীর ধারে…একা।
ভাবতে ভাবতে দেখি সেই নদী, সেখানে একটি দুর্গা প্রতিমার মুখ আপনমনে ভেসে যাচ্ছে। ভিড়ের ভেতরে কেউ যেন বলল ওই তো উমা মায়ের মুখ। আবার কে যেন বলে উঠল না, না। এ হচ্ছে কাগা-বগার মায়ের মুখ…।
সব ভাবনা এখন আমার ভেতরে। আর প্রবল ঢাকের শব্দে আমার গচ্ছিত সব ভাবনা যেন ডুবে যাচ্ছে নদীর জলে।