শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি : আড়াই হাজার কোটি টাকা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। এই বিপুল পরিমাণ টাকায় ফুলবাড়ি সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে তৈরি হচ্ছে বিশাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। শিলিগুড়ি শহরের থেকে ওই এলাকা খুব একটা দূরে নয়। এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ার টাকা জোগাচ্ছে চিন। আড়াই হাজার কোটি টাকার ওই প্রকল্পের চেয়ারম্যান হলেন চিনা ব্যবসায়ী ঝুযাং লিফেং। তিনিই মূল বিনিয়োগকারী। প্রকল্পের কাজের নামে সীমান্তে ঘাঁটি গেড়েছেন চিনা ইঞ্জিনিয়াররা। আর চিনের এই তৎপরতায় জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারতীয় গোয়েন্দারা।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যেই, পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পাশে দাড়িয়াপাড়া এলাকায় ৩২ একর জায়গাজুড়ে মেডিকেল কলেজ তৈরির কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে নর্থ পয়েন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। যেখানে প্রকল্প হচ্ছে সেখান থেকে ফুলবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আর জলপাইগুড়ির চাউলহাটির দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার। চিনা প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গত ৮ এপ্রিল বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি ওই প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকার দূতাবাসের চিনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়ে সহ একাধিক চিনা প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। শিলিগুড়ি করিডর ঘেঁষে সীমান্তের এত কাছে বিপুল পরিমাণ চিনা বিনিয়োগ কেন? উত্তর খুঁজছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা।
এক দেশের ব্যবসায়ীদের অন্য দেশে বিনিয়োগ নতুন ঘটনা নয়। তবে শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক ঘেঁষে চিনা বিনিয়োগের পেছনে বড়সড়ো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। নেপাল ও ভুটানকে ব্যবহার করে চিন যে ভারতবিরোধী নানা পরিকল্পনা ছকছে সেকথা আগেই প্রকাশ্যে এসেছে। বাংলাদেশেও সক্রিয় ভারতবিরোধী একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী। সম্প্রতি ভুটানজুড়ে নির্মীয়মাণ কোয়ারান্টিন সেন্টার ও ল্যাব নিয়ে বাড়ছে রহস্য। আর এরমধ্যেই ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষে চিকিৎসা ও সেই সংক্রান্ত গবেষণায় চিনের বিনিয়োগ স্বাভাবিকভাবেই নানা প্রশ্ন উসকে দিয়েছে। তাহলে চিন কি চিকেন নেক ঘিরে ফেলতে নয়া পরিকল্পনা করছে? এই প্রশ্নই ঘুরছে ভারতীয় গোয়েন্দা মহলে।
বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবরও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। পঞ্চগড়ে চিনা বিনিয়োগ নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছে বিএসএফ। বিএসএফের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিকের বক্তব্য, বেছে বেছে শিলিগুড়ি করিডর ঘেঁষেই চিনের বড় বিনিয়োগ কোনও সহজ সমীকরণ নয়। অনেক পরিকল্পনা করেই ওই প্রকল্প শুরু হয়েছে। ওই চিনা প্রকল্পের উদ্বোধনের দিনের ভিডিও আমরা দিল্লিতে পাঠিয়েছি। উদ্বোধনের দিন ভারতবিরোধী নানা কথা বলা হয়েছে। গোটা বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
পরিকল্পনা অনুসারে সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজে এক হাজার বেড থাকবে। তবে হাসপাতালের পরিকাঠামোর বাইরেও কলেজ চত্বরে বেশ কয়েটি হোটেল তৈরি হবে। ৩২ একরের মধ্যে সাত একর জমিতে হবে মেডিকেল কলেজের নির্মাণকাজ এবং ১০ একর জলাভূমি হিসাবে রাখা হবে। চিনের নাগরিকদের জন্য আলাদা বিল্ডিং তৈরি করা হবে বলেও জানা গিয়েছে। প্রকল্পের ডিপিআর হাতে পেয়েছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা। পাওয়া গিয়েছে মডেল নকশাও।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুসারে পঞ্চগড়ে প্রকল্প এলাকায় বিশাল তাঁবু বানিয়েছে চিনা কোম্পানি। চিন থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় একশোজনের একটি দল প্রকল্পের কাজের জন্য পঞ্চগড়ে ঘাঁটি গেড়েছে। চিনের ইঞ্জিনিয়াররাই যাবতীয় কাজ পরিচালনা করছেন। স্থানীয় ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকল্পের কোনও কাজেই রাখা হয়নি। মাঝেমধ্যেই এলাকায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনও ওড়াচ্ছেন চিনা ইঞ্জিনিয়াররা। কী কারণে ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা বেড়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, ড্রোনের মাধ্যমে সীমান্তে গোপনে নজরদারি চালাচ্ছে চিন।
আরও একটি বিষয় সন্দেহ বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। নির্মীয়মাণ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দাযিত্বে বসানো হয়েছে বাংলাদেশ-চিন মৈত্রী কেন্দ্রের মহাসচিব এইচএম জাহাঙ্গির আলম রানাকে। জাহাঙ্গির আলম বাংলাদেশে চিনপন্থী হিসাবেই সুপরিচিত।
এক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা আধিকারিকের বক্তব্য, বিদেশিরা বিনিয়োগ করে ব্যবসায়িক লাভের জন্য। যে এলাকায় প্রকল্প হচ্ছে, বাংলাদেশে তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক এলাকা আছে। যেখানে ওই প্রকল্প হলে ব্যবসায়িক দিক থেকে অনেক বেশি লাভ করা যেত। তা না করে চিকেন নেকে ঘেঁষে প্রকল্প নিশ্চিতভাবেই চিনের গোপন পরিকল্পনার অংশ। চিন ঘুরপথে চিকেন নেক ঘিরে ফেলতে চাইছে কি না সেদিকে আমরা নজর রাখছি।