শৌভিক রায়: নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে অটোরিকশায় উঠতেই তাঁদের মুখে হাসি। রাতজাগা চেহারা প্রায় প্রত্যেকের। শরীরে স্পষ্ট ক্লান্তি। কিন্তু মুখে প্রশান্তির ছাপ। জানতে চাইলাম, কোথা থেকে আসছেন সব। সমস্বরে উত্তর এল, রাজস্থান থেকে। রাজমিস্ত্রির জোগানদারের কাজ সেরে ঘরে ফিরছেন এবার। দীর্ঘ এক বছর পর। এর মধ্যে আসেননি কেন আর? প্রশ্নের উত্তরে বললেন, বারবার আসার পয়সা কোথায়? তাছাড়াও উপলক্ষ্য তো একটা দরকার। টগবগে মনে তাঁরা বাড়ির পথ ধরলেন, মনে হল, আমাদের দুর্গারা এসে গিয়েছেন!
নিউ কোচবিহার স্টেশনে এখন এই দুর্গাদেরই ঢল। কেউ গিয়েছিলেন কেরলে, কেউ মহারাষ্ট্রে, কেউ আবার তেলেঙ্গানায়। কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ নিতান্তই ঘরনি। পুজোর কয়েকদিন বাড়িতে কাটিয়ে ফিরবেন কর্ম-কৈলাসে। তার আগে এই কয়েকদিন নিজেদের পরিচিত পরিবেশে আবার সেই পুরোনো হয়ে যাওয়া। সবার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা। ভালোমন্দ খাওয়া। পুকুরে নেমে শাপলা তোলা। সবুজ ধান গাছে পরম মমতায় হাত বোলানো।
এই দুর্গারা কিন্তু খালি হাতে আসেন না। বাড়ির প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু আনতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। মালপত্র বেশি হয় বলে, অনেকে কেনাকাটা সারেন ঘরে ফিরে। স্থানীয় অর্থনীতিতে তাঁদের এই সামান্য যোগদান কি অর্থনীতির গবেষকদের বিষয় হতে পারে না? প্রশ্ন জাগে।
উত্তর পেতে না পেতেই দেখি, টিফিনের ব্যাগ, জলের বোতল আর ছাতা নিয়ে রমা ম্যাডাম চলেছেন স্কুলে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রোজেক্টে, রাজ্য সরকারের স্কুলে তিনি কম্পিউটার দিদিমণি। তাঁর মতো অনেকেই জেলার নানা স্কুলে। সামান্য বেতন। দিনভর ক্লাস। কিন্তু এই নেই-চাকরির রাজ্যে এটুকুই বা কম কী! উপরি পাওনা তো ছাত্রদের তুমুল ভালোবাসা। তাঁদের মতোই পিছিয়ে রয়েছেন কি কোচবিহারের বিখ্যাত তামাক ও পাটশিল্পে, পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উদযাস্ত পরিশ্রম করা দুর্গারা? কিংবা শহরের নার্সিংহোমে কর্মরত নাজিরহাট বা কৃষ্ণপুরের লাজুক মেয়েটি? অথবা জেলার বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করা মহিলারা? বা পার্লার, ফাস্ট ফুড, কসমেটিক্সের দোকানের তরুণী থেকে মধ্যবয় স্করা? না। কেউ পিছিয়ে নেই। সবকিছু সামলে আক্ষরিক অর্থেই তাঁরা দশভুজা!
পাশাপাশি সাধারণ গৃহিণীদের কথা ভুললে চলবে না। কর্পোরেট অফিসের সময় ধরা রুটিনের মতোই তাঁদের যাপন। সেই কোন সকালে ওঠা আর তারপর অসামান্য দক্ষতায় অনায়াসে সব সামলানো। চোখের পলকে দুটি হাত কখন যে দশটি হয়ে যায় বোঝাও যায় না। তাঁদের কর্তব্যে গাফিলতি নেই একচুলও। তাঁদের নিত্য কাজের সামান্য হেরফের কিন্তু থামিয়ে দিতে পারে দিনের স্বাভাবিক ছন্দ।
তবু মনে পড়ে যায় অশীতিপর সেই দুর্গাদের। আধুনিকতার আশীর্বাদে আজ জেলাতেও বৃদ্ধাশ্রম। পুরু কাচের ঘোলাটে চোখে, টলমল পায়ে দল বেঁধে তাঁরা উমা দর্শনে আসেন। ভাবি, দুর্গাদের পরিণতি কি এটাই? ছোট্ট একটা ঘর। একটা টিভি। কিছু সিরিয়াল। মলাটে হাত বোলানোর জন্য দুই-চারটে বই। দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কার জন্য? নিজের কার্তিক, গণেশ, সরস্বতী বা লক্ষ্মীর জন্য? নাকি জীবনের চরম সত্যের জন্য!
উত্তর জেনেও, উত্তর খুঁজি বোকার মতো।
(লেখক কোচবিহারের বাসিন্দা। শিক্ষক ও সাহিত্যিক)