শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশাসন পরিচালনায় যার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই তিনি কীভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব সামলাবেন তা নিয়ে শিক্ষক, ছাত্র সব মহলেই প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্ন যে অমূলক নয়, বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে সেকথা কার্যত স্বীকার করে নিলেন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তা সিএম রভীন্দ্রন। নানা প্রশ্নের উত্তরে তিনি বুঝিয়ে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থা বা প্রশাসন সম্পর্কে কিছুই জানেন না তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি বা পরিকাঠামোতো নয়ই, পাঠ্যক্রম, সিমেস্টার, গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালও নন তিনি। কাগজে-কলমে দায়িত্ব গ্রহণের পর এদিন পুলিশ কর্তা হিসাবে কোথায় কী কাজ করেছেন সেই গল্পই শোনা গেল রভীন্দ্রনের মুখে।
৩০ সেপ্টেম্বর রভীন্দ্রনকে উপাচার্যের দায়িত্ব সামলানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। তিস্তার বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শনে এদিন উত্তরবঙ্গে এসেছিলেন রাজ্যপাল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগে বাগডোগরা বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন রভীন্দ্রন। যদিও সেই বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাৎ বলেই উল্লেখ করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানানো হয়েছে, ক্যাম্পাসে থাকা উপাচার্যের বাংলোতে নয়, কদমতলা এলাকায় বিএসএফের অতিথি নিবাসেই থাকবেন ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য। যা নিয়ে শোরগোল পড়েছে ক্যাম্পাসে। এদিন দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ করেই ক্যাম্পাস ছাড়েন রভীন্দ্রন।
ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেখানেই উত্তরবঙ্গ সংবাদের পক্ষ থেকে নানা প্রশ্ন করা হয় তাঁকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে না জেনে কীভাবে কাজ চালাবেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে রভীন্দ্রন জানান, তাঁর ভাইঝি সহ অনেক আত্মীয়রা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তাঁদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বহু তথ্যই জেনেছেন তিনি। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের ব্যাখ্যা শুনে তাঁর ঘরে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মী মুখ টিপে হাসছিলেন। আত্মীয়দের চাকরি যোগ্যতা হিসাবে কবে থেকে বিবেচিত হচ্ছে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই প্রশ্ন তোলেন ওই কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এর নিয়ম অনুসারে উপাচার্য হওয়ার জন্য নূন্যতম দশ বছরের অধ্যাপনা ও শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনার অভিজ্ঞতা দরকার। সেসব কিছু না থাকলেও কেন রাজ্যপাল তাঁকে উপাচার্যের দায়িত্ব দিলেন? রভীন্দ্রনের কথা, আমি তো অস্থায়ী। স্থাযী উপাচার্য এলে চলে যাব।
রাজ্যপালের সঙ্গে সুসম্পর্কের জন্যই তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সেই প্রশ্ন করতেই রভীন্দ্রন বলেন, আমি যে ব্যাচে আইপিএস অফিসার, রাজ্যপাল সেই ব্যাচের আইএএস। তাই বলে সেই কারণে আমি পদ পাইনি। আমি উত্তর-পূর্ব ভারত বিশেষজ্ঞ। এই এলাকায় চিন সীমান্ত আছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় সেনার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণাধর্মী কোর্স চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। সেই কারণেই হয়তো রাজ্যপাল আমাকে বেছে নিয়েছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সঙ্গে চিন সীমান্তের কী সম্পর্ক তার ব্যখ্যা মেলেনি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের কথায়। গবেষকদের গবেষণাপত্র মূল্যয়ন বা অনুমোদন, গবেষণার বিষয় নির্বাচনের অনুমোদন, পাঠ্যক্রমের চড়ান্ত রূপরেখা তৈরি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে উপাচার্যের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সেই সমস্ত বিষয় না বুঝলে কীসের ভিত্তিতে অনুমোদন দেবেন? রভীন্দ্রনের কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও আধিকারিকরাই সেসব দেখবেন। আমিতো পুলিশে ছিলাম। অতকিছু জানি না।
বারবার প্রশ্ন করায় একসময় খানিক বিরক্ত হন ভাপরপ্রাপ্ত উপাচার্য। পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আমাকে কী অশিক্ষিত মনে হয়? তারপরই ফের নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে শুরু করেন তিনি। তামিলনাডুতে জঙ্গী দমনের বিশেষ অভিযানে তিনি সবথেকে যুব সদস্য ছিলেন সেটাও উল্লেখ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মী সংকট, স্থায়ী রেজিস্ট্রার, ফিন্যান্স অফিসার না থাকা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রভীন্দ্রন স্পষ্ট জানিয়ে দেন ওইসব বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও কর্মীদের উন্নয়ন করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যকে স্বাগত জানাতে হাতে গোনা কয়েকজন কর্মী, আধিকারিককে দেখা গিয়েছে তাঁর দপ্তরে। তবে দিনের শেষে শিক্ষা নিয়ে রভীন্দ্রনের কথায় কার্যত হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, আধিকারিক থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ। প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও পুলিশ দিয়ে ছাত্র পড়ানোর কাজ কতটা হবে সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে।