প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান: বিদ্যা ও জ্ঞানের দেবী হলেন সরস্বতী। হিন্দু ধর্মমতে সৃষ্টির দেবতা ব্রহ্মাই প্রথম তাঁর স্ত্রী সরস্বতীর পুজো(Saraswati Puja) করেন। পরে গোটা জগৎতে দেবী সরস্বতীর পুজো প্রতিষ্ঠা পায়। তার মধ্যে এই বাংলারই পূর্ব বর্ধমানের কালনা(Kalna) যেন দেবী সরস্বতীর সর্বশ্রেষ্ঠ আরাধ্যভূমি হিসেবে পরিচিতি বহন করে চলেছে। দুর্গোৎসব বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হলেও বহুকাল ধরে কালনার বাসিন্দারা সরস্বতী পুজোকেই তাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে মান্যতা দিয়ে আসছেন। কিন্তু কেন দেবী সরস্বতী কালনাতেই এত জনপ্রিয়তা পেলেন, তা হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। তবে এর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এক প্রাচীন ইতিহাস।
সরস্বতী পুজো ঠিক কবে কালনার ঐতিহ্য হিসেবে স্থান করে নেয় তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ইতিহাস বলছে, আজ থেকে তিনশো বছর আগে শিক্ষা অর্জনের বহু ’টোল’ ও ’চতুষ্পাঠী’ ছিল কালনা শহর ও শহরতলিতে। ১৮৩৫ সালে উইলিয়াম অ্যাডামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮৩৫ সালে বর্ধমান জেলায় ১৯৫টি চতুষ্পাঠী ছিল। তার মধ্যে কালনায় ছিল ৫৭টি। এছাড়াও কালনা শহর ও শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা ও পূর্বস্থলী-১ ব্লক সহ আশেপাশে ছিল আরও বহু চতুষ্পাঠী। এর মধ্যে তারানাথ তর্ক বাচস্পতির চতুষ্পাঠী, অক্ষয় ভট্টাচার্যের চতুষ্পাঠী, সীতানাথ তর্কবাগীশের চতুষ্পাঠী, রোহিনী চতুষ্পাঠী, কালিদাস চতুষ্পাঠী ও রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের চতুষ্পাঠী কালনায় উল্লেখযোগ্য ছিল। কালনার বিশিষ্টজনেদের মতে একদা কালনার টোল ও চতুষ্পাঠী গুলিতে শুরু হওয়া সরস্বতী পুজোই পরবর্তীকালে কালনায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুজো হিসেবেই মান্যতা পেয়ে যায়। সেই মতোই কালনায় শুরু হয়ে যায় সরস্বতী পুজোর প্রচলন।
কালনার টোল ও চতুষ্পাঠীগুলিতে যে সরস্বতী পুজো হত তাতে হয়তো এখনকার মত জৌলুস বা থিমের ঘনঘটা ছিল না। তবে তখনকার সময়ে টোল ও চতুষ্পাঠীতে হওয়া সরস্বতী পুজোয় ভক্তিভাবের কোনও শেষ ছিল না। হোগলাপাতার মণ্ডপে রকমারি বাহারি গাছগাছালি দিয়ে তখন তৈরি হত মণ্ডপ। আলপনা দেওয়া হতো মণ্ডপের চারপাশের অঙ্গনজুড়ে। তেলের বাতি সেই মণ্ডপে শোভা পেত। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে টোল ও চতুষ্পাঠীগুলি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলেও কালনাবাসী আঁকড়েই ধরে থাকেন দেবী সরস্বতীকে। পরে নদীকেন্দ্রিক বাণিজ্য নগরী কালনার ব্যবসায়ীদের হাত ধরে কালনার বিদ্যালয়, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরস্বতী পুজো ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী পুজো কালনায় সর্বজনীন রূপ পায়। তাতে আধুনিকতা ও জৌলুসের ছোঁয়াও লাগে।
কালনার ইতিহাস গবেষক সোমনাথ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘অতীতে নবদ্বীপকে বাংলার অক্সফোর্ড বলা হলেও সেইসময়ে কালনা মহকুমার পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত টোল ও চতুষ্পাঠীর খ্যাতিও কোনও অংশে কম থাকেনি। কালনা মহকুমার পূর্বস্থলী-১ ব্লকের মাগনপুরে বৈষ্ণব শ্রেষ্ঠ চৈতন্যদেবের বাল্যশিক্ষার কেন্দ্র তার প্রমাণ করে। এছাড়াও তারানাথ তর্ক বাচস্পতি সহ একাধিক খ্যাতি সম্পন্ন পণ্ডিত তদানিন্তন সময়ে বসবাস করতেন কালনা শহর ও শহরতলিতে।‘
এবছর কালনার উল্লেখযোগ্য সরস্বতী পুজোগুলির মধ্যে রয়েছে কালনার ১০৮ শিবমন্দির সংলগ্ন স্পুটনিক ৭০ পুজো কমিটির পুজো। এবার তাদের থিম ‘সনাতনীর আরাধনা’। পর্যটনকেন্দ্র কালনার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শতাধিক মন্দিরের আদলেই এখানে তৈরি হয়েছে দেবী সরস্বতীর সাজসজ্জা। এছাড়াও প্রতিমা তৈরিতে উপকর হিসেবে বিভিন্ন শস্য ও ধতুর ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে সাদা ও কালো তিল সহ কাঁসা ও পিতলও রয়েছে। এই ক্লাবের প্রতিমার মুখ তৈরি করা হয়েছে সাদা তিল দিয়ে। আর প্রতিমার চোখ তৈরি করা হয়েছে কালো তিল দিয়ে। এছাড়াও অন্যান্য সাজসজ্জায় তামার পাত ও পিতল ব্যবহৃত হয়েছে। এইরমকই কালনার বিভিন্ন ক্লাবের তরফে নানান থিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।