শুভঙ্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি: স্কলারশিপ কেলেঙ্কারিতে নাম জড়াল উত্তরবঙ্গের আট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আর তার তদন্তে উত্তরবঙ্গে এল পাঁচ সদস্যের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল। ভুয়ো তথ্য ও নথি দিয়ে বিভিন্ন স্কলারশিপের কোটি কোটি টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। সেই প্রতারণাচক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসাবে নাম উঠেছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক প্রাক্তন ছাত্রের। উত্তরবঙ্গ, গৌড়বঙ্গ, রায়গঞ্জ তিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ, মালদা, কোচবিহার ও দার্জিলিংয়ের তিনটি কলেজ ও শিলিগুড়ির ফাঁসিদেওয়ার একটি স্কুল নিয়ে তদন্ত শুরু করছে কেন্দ্রীয় দল।
তদন্তের কথা স্বীকার করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বপনকুমার রক্ষিত। তাঁর কথা, ‘স্কলারশিপ কেলেঙ্কারির তদন্তে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। আমাদের ৩২ জন ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে ওঁদের নানা প্রশ্ন ছিল। আইন বিভাগের এক ছাত্র সম্পর্কে বিশেষভাবে জানতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া আরও বেশ কিছু তথ্য চেয়েছিলেন। সেইসব তথ্য আমরা দিয়ে দিয়েছি। ভয়ংকর দুর্নীতি হয়েছে। আমরা চাই যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের কড়া শাস্তি হোক।’ কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের কোনও সদস্য অবশ্য তদন্ত নিয়ে মুখ খুলতে চাননি।
কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলে কেন্দ্রীয় অডিট বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন বিভাগের বাছাই করা আধিকারিকরা রয়েছেন। প্রাথমিকভাবে আট প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুশো ছাত্রছাত্রী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন তদন্তকারীরা। সংশ্লিষ্ট পড়ুয়ারা কবে ভর্তি হয়েছিলেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন কি না, যদি প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দিয়ে থাকেন তাহলে কবে ছেড়েছেন, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। পড়ুয়াদের সম্পর্কে একটি সার্বিক রিপোর্ট ছাড়াও তথ্যের সাপেক্ষে প্রামাণ্য নথিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়েছে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট সংক্রান্ত বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নথিও সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা।
প্রাথমিক তদন্তের পর স্কলারশিপ কেলেঙ্কারিতে মাস্টারমাইন্ড হিসাবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের যে প্রাক্তন ছাত্রের নাম উঠেছে তাঁর পরিবার সম্পর্কেও খোঁজখবর শুরু করেছে কেন্দ্রীয় দল। সূত্রের খবর, সেই ছাত্রটির বাড়ি মালদায়। বছর তিনেক আগেই তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের একটি কোর্সে পড়াশোনা করছেন।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ল’ইউনিটের নেতৃত্ব দিতেন ছাত্রটি। কেন্দ্রীয় দলের তদন্ত শুরুর খবর চাউর হতেই শোরগোল পড়েছে ক্যাম্পাসে। কেলেঙ্কারিতে সংগঠনের নাম জড়ানোয় খানিকটা বিপাকে পড়েছে টিএমসিপি। যদিও সংগঠনের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা নেতা মিঠুন বৈশ্যর কথা, ‘যে ছাত্র সম্পর্কে খোঁজখবর চলছে তিনি কয়েকবছর আগেই ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। তিনি সংগঠনের সমর্থক ছিলেন। তবে কখনোই কোনও দায়িত্বে ছিলেন না। বর্তমানে তাঁর সঙ্গে সংগঠনের কোনও সম্পর্ক নেই।
মূলত পাঁচটি স্কলারশিপের ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারির কথা বলা হচ্ছে। তার মধ্যে সংখ্যালঘুদের স্কলারশিপেই বেশি প্রতারণা হয়েছে। যে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে তাঁদের কারও নামে পাঁচবার, কারও নামে ছয়বার বিভিন্ন স্কলারশিপের টাকা উঠেছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে কেন বারবার ঘুরেফিরে আট প্রতিষ্ঠানের চিহ্নিত শ-দুয়েক ছাত্রছাত্রীর নাম আসছে তা নিয়ে ধন্দে তদন্তকারীরাও। সেই ছাত্রছাত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকেও নথি সংগ্রহ করছেন তদন্তকারীরা। স্কলারশিপের টাকা তাঁদের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে নাকি অন্যত্র চলে গিয়েছে সেটাও যাচাই করা হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নথি সংগ্রহের পর ধাপে ধাপে সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতিও শুরু করেছে কেন্দ্রীয় দল। চিহ্নিত পড়ুয়াদের কাছ থেকে মুচলেকাও নেওয়া হতে পারে।