Friday, May 3, 2024
HomeMust-Read Newsএকনায়কতন্ত্রের ছায়া: ভারত-আর্জেন্টিনার মিল শুধু ফুটবলপ্রীতিতে নয়

একনায়কতন্ত্রের ছায়া: ভারত-আর্জেন্টিনার মিল শুধু ফুটবলপ্রীতিতে নয়

প্রতীক: গত বছর ১৮ ডিসেম্বর ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। ফাইনালের আগে এবং পরে ভারতের বহু জায়গায় ভারতীয়রা আর্জেন্তিনীয় হয়ে গিয়েছিলেন। নেহাত আর্জেন্টিনা মুসলমান-প্রধান দেশ নয়। নইলে যে হারে আর্জেন্টিনার পতাকা ঝোলানো হয়েছিল পাড়ায় পাড়ায়, কেবল পশ্চিমবঙ্গেই কয়েক হাজার লোকের নামে দেশদ্রোহের মামলা রুজু হয়ে যেত। এখনও সোশ্যাল মিডিয়া খুললে দেখা যাচ্ছে শত শত ভারতীয় এক বছর আগের সুখস্মৃতি রোমন্থন করছেন। এবছর ১৮ ডিসেম্বর বোঝা গেল, ভারত আর আর্জেন্টিনার মিল শুধু ফুটবলপ্রীতিতে নয়।

সবে আর্জেন্টিনায় ক্ষমতায় এসেছে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি খাভিয়ে মিলেইয়ে লিবার্টি পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট। এসেই দেশের মুদ্রার মূল্য অর্ধেক করে ফেলেছে এবং তা নিয়ে প্রতিবাদ হবে বুঝে নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী পাত্রিসিয়া বুলরিক বলে দিয়েছেন, যেসব সংগঠন বা ব্যক্তি প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করবে তাদের ডিজিটাল বা সাধারণ উপায়ে চিহ্নিত করা হবে। তারপর প্রতিবাদ আটকাতে যে নিরাপত্তাবাহিনী ব্যবহার করা হবে তার খরচ প্রতিবাদীদের থেকেই আদায় করা হবে। আরও যোগ করেছেন, আমরা বহু বছর সম্পূর্ণ অরাজকতার মধ্যে কাটিয়েছি। এসব খতম করার সময় এসেছে। আন্দোলন, প্রতিবাদকে এক্সটরশন আখ্যা দিয়ে বলেছেন, রাস্তাঘাটে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে নাগরিকরা অনেক ভুগেছেন। আর চলবে না। কাণ্ড দেখে বামপন্থী সাংসদ মিরিয়াম ব্রেগমান সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন, বুলরিক যা ঘোষণা করেছেন তা একেবারে অসাংবিধানিক। প্রতিবাদের অধিকার সব অধিকারের মধ্যে প্রথম অধিকার। তাতে ক্ষমতাসীন জোটের নেতা হোসে লুইস এসপার্ত সটান জবাব দিয়েছেন, হয় কারাগার নয় বুলেট।

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বা মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ চৌহান বা দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের বুলডোজার চালানো, প্রতিবাদীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আইন প্রণয়নের সঙ্গে আর্জেন্টিনার সরকারের কার্যকলাপের আন্তরিক মিল। তবে প্রেসিডেন্ট মিলেই আর্জেন্টিনায় সবে ক্ষমতায় এলেন, জাঁকিয়ে বসতে সময় লাগবে। নরেন্দ্র মোদির সরকার দুটো মেয়াদ পূর্ণ করতে চলল, তৃতীয় মেয়াদের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ফলে তাঁর সরকারের দমননীতি আরও বেপরোয়া হওয়াই স্বাভাবিক।

দেশে বেকারত্বের হার ইংরেজ আমলের হারে পৌঁছে গিয়েছে, জিডিপির হিসেব সন্দেহজনক, ছোট ও মাঝারি ব্যবসাগুলো ধুঁকছে, অনাহারের আন্তর্জাতিক সূচকে ভারত নেমেই চলেছে, এসব তথ্য প্রায় সমস্ত মূলধারার সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম পকেটে থাকা সত্ত্বেও চেপে রাখা যাচ্ছে না। বিদেশনীতি বেশ নড়বড়ে দেখাচ্ছে, দক্ষিণ ভারতে যে রাজ্যে বিজেপি সবচেয়ে শক্তিশালী সেখানে বড় হার হল কিছুদিন আগে। এইসব কারণে সম্ভবত মোদি-অমিত শারা মাঝে কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। কিন্তু রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিরাট জয়ে তাঁরা বুঝে ফেলেছেন যে ভারতের প্রাণকেন্দ্র এখনও হাতের মুঠোয়। ফলে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের স্লোগান বদলে ফেলা হয়েছে বিরোধীমুক্ত সংসদের অনুচ্চারিত নির্দেশে।

তাই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের বর্ষপূর্তির দিনে ইতিহাস সৃষ্টি করে শতাধিক সাংসদকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে পুরো শীতকালীন অধিবেশন থেকে। কে জানত রোহিত শর্মার ক্রিকেট বিশ্বকাপের স্ট্রাইক রেট টপকে যাবেন দুই বৃদ্ধ ওম বিড়লা আর জগদীপ ধনকর! শচীন তেন্ডুলকার সম্পর্কে অভিযোগ ছিল, তিনি নব্বইয়ে ঘরে ঢুকে মন্থর হয়ে যান। সম্প্রতি বিরাট কোহলির বিরুদ্ধেও সেরকম অভিযোগ উঠছে। কিন্তু ওম আর জগদীপ ১৮ তারিখ পর্যন্ত ৯২ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে গতি কমাননি। পরদিনই সোজা ১৪১-এ পৌঁছে গিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত অধিনায়কের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেওয়া এবং তা নিয়ে দেশব্যাপী বর্ণাঢ্য প্রচারের অভিলাষ তাঁরই নামাঙ্কিত মাঠে মারা গিয়েছিল, যার অন্যতম কারণ কোহলিদের মন্থর ব্যাটিং। একেবারে সুদে আসলে পুষিয়ে দিচ্ছেন সংসদের দুই কক্ষের কর্ণধার।

কেউ রেগে উঠে বলতেই পারেন, এটা কি ঠাট্টাতামাশার বিষয়? মুশকিল হল, যেভাবে এতজন বিরোধী দলের সাংসদকে সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে তাতে সংসদ জায়গাটাই তো তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাসপেন্ড হওয়া সাংসদদের অপরাধ কী? কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে কী করে চারজন সটান সংসদের ভিতরে ঢুকে পড়ল, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা। দুজনেই সংসদের বাইরে এ নিযে কথা বলেছেন, সংবাদমাধ্যমে বলেছেন। কিন্তু কিছুতেই সংসদের ভিতরে বলবেন না। কেন বলবেন না? কোনও প্রশ্ন নয়।

সেই রাহুল গান্ধিকে তড়িঘড়ি লোকসভা থেকে সাসপেন্ড করার সময়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে সরকারের অপছন্দের প্রশ্ন করলে সংসদে টিকতে দেওয়া হবে না। মহুয়া মৈত্রকে সাসপেন্ড করার পদ্ধতি সন্দেহকে বিশ্বাসে পরিণত করল। অবশেষে সরকারের গোঁয়ার্তুমির প্রতিবাদ করার জন্য ১৪১ জনকে সাসপেন্ড করার পরে আর অন্যরকম ভাবার অবকাশ নেই। একথা পরিষ্কার যে সংসদে নিজের জায়গা বজায় রাখতে হলে বিরোধীদের স্পিকটি নট হয়ে বসে থাকতে হবে। প্রশ্ন করেছ কি মরেছ।

সাসপেনশনের যে কারণ দেখানো হচ্ছে তা যে নেহাতই লোকদেখানো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গৌতম আদানির মালিকানাধীন একটি চ্যানেলে দেখছিলাম বিজেপি মুখপাত্র শাজিয়া ইলমি আর বিজেপিপন্থী সাংবাদিক স্মিতা প্রকাশ বলছেন, সংসদটা ভদ্র বিতর্কের জায়গা। বিরোধীদের তাতে আগ্রহ নেই, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছিলেন। তাই তাঁদের সাসপেন্ড করেছেন লোকসভার স্পিকার আর রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। বহুজন সমাজ পার্টির সাংসদ দানিশ আলিকে ছাপার অযোগ্য গালাগালি দেওয়া বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরিও তাহলে ভদ্র বিতর্কে লিপ্ত ছিলেন বলে ধরে নিতে হবে। আরেক বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহা, যাঁর সই করা পাস নিয়ে সেদিন সংসদে ঢুকে পড়েছিল চার বিক্ষুব্ধ তরুণ, তিনিও স্পিকারকে ওদের সম্বন্ধে কিছু জানি না বলেই পার পেয়ে গেলেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায় নিতে হল না। অর্থাৎ নিয়ম বিজেপি সাংসদদের জন্য একরকম, বিরোধী দলের সাংসদদের জন্য অন্যরকম।

সে ব্যাপারে অবশ্য বিজেপি নেতাদের বিশেষ রাখঢাক নেই। অরুণ জেটলি সংসদের কাজে বাধা দেওয়াকেও সংসদীয় ব্যবস্থার অঙ্গ বলেছিলেন। ২০০১ সালে সংসদে সন্ত্রাসবাদী হানার পরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিবৃতি দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও বিবৃতি দিয়েছিলেন। এসব বলেও বিজেপি মুখপাত্রদের দমানো যাচ্ছে না। তাঁরা অবলীলাক্রমে বলে দিচ্ছেন, ওসব কবেকার কথা। এখন দিন বদলে গিয়েছে আজ আর ওসব চলবে না।

যা নেহাতই চক্ষুলজ্জার খাতিরে বলছেন না, তা হল গণতন্ত্র-ফন্ত্র আর চলবে না। সে কারণেই তো ইংরেজ আমলের ফৌজদারি দণ্ডবিধির আধুনিকীকরণের নামে নিয়ে আসা হয়েছে এমন আইন যা পুলিশকে দেবে আরও একচ্ছত্র ক্ষমতা। সরকারের আস্তিনে আছে নতুন টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত বিল, যা আইনে পরিণত হলে কোনও ব্যক্তির বা কোনও এলাকার টেলিযোগাযোগ সরকার সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারবে নিজের বিবেচনা অনুযায়ী। আরও আছে পোস্টাল পরিষেবা সংক্রান্ত আইন, যা মোতাবেক পোস্ট অফিস যে কোনও চিঠি বা পার্সেল খুলে ফেলতে পারবে। দরকার বুঝলে তা প্রাপকের কাছে নাও পাঠাতে পারে।

একনায়কতন্ত্রের ছায়া ঘনিয়ে এল। এদিকে বিরোধীরা তাঁদের অর্ধেকের বেশি সাংসদ সাসপেন্ড হয়ে যাওয়ার পরেও লক্ষ্মী হয়ে সংসদের সিঁড়িতেই ধর্না দিচ্ছেন। কে কটা আসনে লড়বেন তা নিয়ে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে আলোচনা হচ্ছে, মমতা ব্যানার্জি রাহুল গান্ধিকে পাশ কাটিয়ে জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে মল্লিকার্জুন খাড়গের নাম করছেন। এ রাজ্যের বামেরা আরও এককাঠি সরেস। তাঁরা মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে ইনসাফ যাত্রা নামক কী একটা কর্মসূচিতে নামিয়ে দিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখছেন তৃণমূলকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। অথচ বিজেপি ২০২৪ নির্বাচন জিতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটা থাকবে কি না, তার বিধানসভার গঠন কী হবে তার ঠিক নেই। সুতরাং ভারতীয় গণতন্ত্র বাঁচবে কি না, এ প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর দেওয়া চলে–সবই রামের ইচ্ছে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Drug recovery | স্কুটারের পাদানিতে লুকোনো ছিল সাড়ে তিন কোটির মাদক, যুবককে ধরল পুলিশ

0
ফালাকাটা: মাত্র ১ মাস ১ দিনের ব্যাবধান। ফের বিপুল পরিমান ব্রাউন সুগার জাতীয় নিষিদ্ধ মাদক (Drug recovery) সহ ১ যুবককে গ্রেপ্তার করল ফালাকাটা থানার...

Madhyamik 2024 | বাবা দিনমজুর, মেধাতালিকায় স্থান না পেলেও মাধ্যমিকে নজর কাড়ল দীপজয়

0
চ্যাংরাবান্ধা : মেধাতালিকায় তার স্থান হয়নি চ্যাংরাবান্ধা (Changrabandha) গ্রাম পঞ্চায়েতের চৌরঙ্গী এলাকার বাসিন্দা দীপজয় সরকারের। সেই প্রত্যাশাও ছিল না তার। কিন্তু দিনমজুর ঘরের ছেলে...

Madhyamik Result 2024 | মাধ্যমিকে জলপাইগুড়ির অন্য স্কুলগুলিকে টেক্কা দিল নাগরাকাটার একলব্য মডেল

0
নাগরাকাটা: মাধ্যমিকে (Madhyamik Result 2024) সামগ্রিক ভালো ফলের নিরিখে ফের জলপাইগুড়ির (Jalpaiguri) অন্যান্য স্কুলগুলিকে টেক্কা দিল নাগরাকাটার একলব্য মডেল স্কুল (Nagrakata Eklavya Model School)।...

Malda | লোকসভার প্রচারে চাঁচলে তৃণমূলের মিছিল, পা মেলালেন শিলিগুড়ির মেয়র গৌতম দেব

0
চাঁচল: লোকসভা ভোটের (Lok Sabha Election 2024) আগে বৃহস্পতিবার বিকেলে মালদার (Malda) চাঁচল ১ (Chanchal) এর কলিগ্রাম অঞ্চলে তৃণমূলের (TMC) মিছিলে জনজোয়ার। এদিন মিছিলে...

Madhyamik Result 2024 | বাবা সাইকেল মিস্ত্রি, মাধ্যমিকে ৬২১ পেয়েও পছন্দের বিষয় অধরা মহম্মদ...

0
সিতাই: চোখে স্বপ্ন বড় হওয়ার। তাই আর্থিক অনটন বাধা হতে পারেনি কোচবিহার জেলার সিতাই (Sitai) ব্লকের চামটা আদর্শ হাইস্কুলের পড়ুয়া মহম্মদ আরেনের পথে। মাধ্যমিকে...

Most Popular