নয়াদিল্লি: বিহার ও ঝাড়খণ্ডের একটি বড় অংশ বাঙালি অধ্যুষিত। দীর্ঘসময় ধরে বাঙালি সংস্কৃতি মিশে রয়েছে এই অঞ্চলের জল-মাটিতে। বহু প্রথিতযশা ও কিংবদন্তি বঙ্গ ব্যক্তিত্ব এই অঞ্চল থেকেই উদ্ভাসিত হয়েছেন। বাংলা তথা বাঙালির সেই ঐতিহ্যেই এবার আঘাত এসেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্তমান বর্ষীয়ান রাজ্যসভা সাংসদ ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা সুপ্রিমো শিবু সোরেন। তাঁর অভিযোগ, ঝাড়খণ্ডের বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন জায়গার রেল স্টেশনগুলির নাম ফলক থেকে বাংলা হরফকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। এই অভিযোগে সরাসরি রেল মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি লিখে অবিলম্বে রেল স্টেশনের নামের ফলকে বাংলা হরফ ফেরানোর দাবিও তুলেছেন শিবু সোরেন।
তাত্পর্যপূর্ণভাবে রেল মন্ত্রীকে লেখা নিজের চিঠিতে ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে বাংলা তথা বাঙালিদের মননের যোগাযোগের প্রমাণ তুলে ধরেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শিবু সোরেন। এই মর্মে তাঁর যুক্তি, ‘স্বাধীনতার আগে ঝাড়খণ্ড এবং বিহার ছিল বৃহত্তর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত। দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই পট পরিবর্তন হয়। বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মানভূম, সিংভূম, ধলভূম এবং রাঢ় অঞ্চলে কয়েক শতাব্দী ধরেই বসবাস করে আসছেন বাঙালিরা। এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পেছনে রয়েছে বাঙালিদের অভাবনীয় অবদান। অথচ তাঁদের অবমাননা করছে সরকার।’ অষ্টম তপসিল ভুক্ত ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হল বাংলা ভাষা। দেশের সংবিধানেও বলা হয়েছে কোনও রকম আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না বলে মত শিবুর। এই প্রসঙ্গেই শিবু সোরেনের সংযোজন, ‘ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিদের আধিক্য এবং ঘনত্বের বিচারে রেল স্টেশনগুলির নাম ফলকে বাংলা হরফের ব্যবহার শুরু হয়েছিল সুদীর্ঘদিন আগেই। রাতারাতি তা পরিবর্তন করার এই প্রচেষ্টা তীব্র নিন্দনীয়। বাঙালিরা এই রাজ্যের অন্যতম অধিবাসী। রেল স্টেশনগুলির ফলক থেকে তাঁদের ভাষা মুছে ফেলার ঘটনায় তাঁরা যথেষ্টই মর্মাহত হয়েছেন। এই পদক্ষেপ একেবারেই কাম্য নয়।’
জেএমএম সুপ্রিমো শিবু সোরেনের চিঠির সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঝাড়খণ্ডের রেল ফলক থেকে বাংলা ভাষা মুছে ফেলার ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে বিরোধী শিবির। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ষীয়ান লোকসভা সাংসদ সৌগত রায় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরাসরি নিশানা করেছেন বিজেপিকে। তাঁর কথায়, ‘বাংলা ভাষার এই অবমাননার বিষয়টিকে সর্বসমক্ষে আনার জন্য শিবু সোরেনজিকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। বিজেপি শাসিত রাজ্য তো বটেই অবিজেপি রাজ্যগুলিতেও বাংলা সহ আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির উপরে গেরুয়া আক্রমণ নতুন নয়। গৈরিকিকরণের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে প্রতিবাদ জানাবো আমরা।’ একই সুর শোনা গিয়েছে বর্ষীয়ান কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যর গলাতেও। তাঁর প্রশ্ন, ‘ইতিহাস বিকৃত করতে আর কত নীচে নামবে কেন্দ্র সরকার?’ তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রেল স্টেশন, সড়কপথের নাম পরিবর্তন করা এদের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন রেল স্টেশন থেকে বাংলা ভাষা মুছে ফেলার এই প্রচেষ্টা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাঙালি তথা অন্য কোনও জাতির ভাবাবেগকে আঘাত করে গৃহীত কোনও পদক্ষেপকে মান্যতা দেবে না দেশের জনতা।’
এর পালটা সুর শোনা গিয়েছে, ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের গলায়। তাঁর মতে, ‘ভাষাগত জাতিবাদের আড়ালে সংকীর্ণ রাজনীতিতে মেতেছেন শিবু সোরেন। অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের স্বীকৃতির জন্যই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে বাংলা ভাষাকে অবমাননা করছে কেন্দ্রীয় সরকার।’ গোড্ডার সাংসদ নিশিকান্তের সংযোজন, ‘ভুলে গেলে চলবে না ঝাড়খণ্ডের বাঙালিদের ঐতিহ্যকে সম্মান দেওয়ার জন্য বরাবরই উদ্যোগী বিজেপি। গিরিডিতে জগদীশ চন্দ্র বসু, মধুপুরে প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবীশের এমনকি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিরক্ষার কাজ করছে বিজেপি। এর আগে কার্মাটার রেল স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে বিদ্যাসাগর করার পিছনেও ব্যক্তিগত পরিসরে আমার বিরাট ভূমিকা আছে। সেই তুলনায় রাজ্যের প্রবাসী বাঙালিদের হিতে কিছুই করেনি, অথচ এখন বঙ্গহিতৈষীর মুখোশ ধারণ করতে চাইছে মোর্চা।’