প্রণব সূত্রধর ও রাজু সাহা, আলিপুরদুয়ার: ছাত্র তৈরির স্বপ্ন নিয়ে কেউ একাধিক চাকরি ছেড়ে বেছে নিয়েছিলেন হাইস্কুলের চাকরি। কেউ বা আবার সরকারি চাকরি পেয়ে আশায় বুক বেঁধে ঋণ নিয়ে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কেউ আবার চাকরি পেয়ে নতুন সংসার পেতেছেন। কিন্তু হাইকোর্টের (Calcutta High Court) রায়ে তাঁদের স্বপ্ন একধাক্কায় ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। দিশেহারা এইসব শিক্ষক। সামনে কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। কী করবেন কোথায় যাবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না।
শহরের এক হাইস্কুলের শিক্ষক ২০১৬ এসএসসি’র (SSC) মাধ্যমে চাকরি পান। গৃহশিক্ষক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি রয়েছে তাঁর। এর আগে একাধিক সরকারি চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেছেন। এমনকি বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাব টেকনিসিয়ান হিসেবে শহরের আরেকটি বিদ্যালয়ে চাকরিও করেছেন। কিন্তু ছাত্র পড়ানোই তাঁর নেশা। সেই কারণে ২০১৬-তে শিক্ষকের চাকরির পরীক্ষা দেন। হাইস্কুলের চাকরি পেলে পুরোনো চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, চাকরির জন্য রাতদিন এক করে পড়াশোনা করেছিলাম। একাধিক চাকরির পরীক্ষায় সাফল্যও পাই। কিন্তু শিক্ষকতা করব বলে অন্য সব ছেড়ে দিই। কিন্তু আজকে এই দিন দেখতে হবে ভাবতেও পারছি না। এখন কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
রেলের চাকরি ছেড়ে হাইস্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ার-২ (Alipurduar) ব্লকের আরেক স্কুলের শিক্ষক। শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের বেশ কয়েকটি চাকরির ডাক পান তিনি। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা করা। তাই অন্য কোনও চাকরিতেই যাননি। এদিন আদালতের নির্দেশে শিক্ষকতার চাকরি চলে যাওয়ায় তাঁর প্রতিবেশীরাও রীতিমতো হতবাক। তিনি বলেন, ‘অভাবের মধ্যে পড়াশোনা করে বড় হয়েছি। ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং রেলের চাকরির পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হই। ২০১৮ সালে রেলের গ্রুপ-সি’র গুডস গার্ড পদে নিয়োগপত্র পাই। ওই চাকরিতেও যোগ দিই। কিন্তু আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষকতা। তাই ২০১৯ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশন থেকে শিক্ষকতার চাকরির নিয়োগপত্র পাই। রেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিই। কিন্তু এখন তো সবই চলে গেল। কী করব জানি না।’
শহরের আরেক শিক্ষিকা শিলিগুড়িতে একটি বিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। সেখানে বাড়ি বানাতে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছেন। চাকরির বেতন থেকে ঋণের খরচ মেটে। চাকরি চলে গিয়েছে। এখন টাকা মেটাবেন কীভাবে তা নিয়ে ভেবে পাচ্ছেন না।
শিক্ষিকার কথায়, কিছু লোকের ভুলের জন্য যোগ্যদের চাকরি চলে যাবে কেন? যোগ্য চাকরিজীবীদের জীবন জীবিকা প্রশ্নচিহ্নের মুখে। এই সমস্যার সুরাহা হওয়া উচিত? কোচবিহার বাসিন্দা আরেক শিক্ষক আলিপুরদুয়ার শহরতলির এক বিদ্যালয়ে কর্মরত। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল নয়। চাকরি পাওয়ার পর সংসারের হাল ফেরে। তিনি বলেন, অভাবের মধ্যে পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছিলাম। ঋণ নিয়েছিলাম। এখন তা পরিশোধ করব কীভাবে?
জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক অফিস সূত্র জানা গিয়েছে, আলিপুরদুয়ার জেলায় চাকরি বাতিলের তালিকায় রয়েছেন ২০৮ জন। বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) আশানুল করিম বলেন, ‘মহামান্য আদালতের আদেশকে মান্যতা দিয়ে আমাদের দপ্তর যেটা যেভাবে করতে বলবে তাই করা হবে।’ পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির আলিপুরদুয়ার জেলা সভাপতি ভাস্কর মজুমদার দোষীদের শাস্তির দাবি জানালেও বিজেপির দিকে আঙুল তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘যেখানে ভুল, অন্যায়, ব্যবস্থা হোক। দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু, যোগ্য প্রার্থীদেরও চাকরি চলে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। আজকে রায় হবে, রায়ের বিষয়বস্তু শুভেন্দু অধিকারী গত পরশু কী করে পেয়ে গেলেন?’ নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতির জেলা সম্পাদক জয়ন্ত সাহা, অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শৈক্ষিক মহাসংঘের জেলা সম্পাদক পিরাজ কিরণ, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির আলিপুরদুয়ার জেলা কমিটির সভাপতি ত্রিদিবেশ তালুকদার সকলে একযোগে রাজ্য সরকারকে ধিক্কার জানিয়েছেন।