প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় এবার উত্তাল দিল্লিও। রাজধানীর একাধিক প্রথমসারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শিক্ষাবিদরা এক সুরে এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। একইসঙ্গে ছাত্রমৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলার শিক্ষাজগতে যে অনিবার্য চাপানউতোর শুরু হয়েছে, তারও নিন্দা করেন শিক্ষাবিদরা। বিষয়টিকে রাজনৈতিক মুনাফার হাতিয়ার না করে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচারের পাশাপাশি সর্বভারতীয় স্তরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘অর্গানাইজড র্যাগিং কালচার’ বন্ধ করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন অধ্যাপক নজফ হায়দার, বিশ্বজিৎ ধর, মুন্সী মহম্মদ ইউনুস সহ একাধিক প্রথিতযশা শিক্ষাবিদরা।
সম্প্রতি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্যু হয় প্রথম বর্ষের বাংলা বিভাগের পড়ুয়ার। এই ঘটনায় র্যাগিংয়ের অভিযোগ ওঠে। ঘটনার সত্যানুসন্ধানে শুরু হয়েছে তদন্ত। এই প্রসঙ্গে সরব হয়েছেন দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. নজফ হায়দার। তিনি বলেন, ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম ‘এলিট’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে একটি৷ সেখানে এক পড়ুয়ার অকাল মৃত্যু বেদনাদায়ক। এ ঘটনার নেপথ্যে যারা তাঁদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার কাজ পুলিশ করবে। কিন্তু এই ঘটনার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এড়াতে পারে না। কর্তৃপক্ষ কী তবে কিছুই জানত না? কেন সময় থাকতে পদক্ষেপ নেওয়া হল না?’ ড. হায়দারের মতে, ‘যাদবপুরকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিক গোটা দেশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের কোনও স্থান নেই। গোটা দেশে অর্গানাইজড র্যাগিং কালচার বন্ধ হোক। যেন দ্বিতীয় কোনও পড়ুয়া এর শিকার না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে সবাইকেই।’
ঘটনার সমালোচনা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকির হোসেন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ড. মুন্সী মহম্মদ ইউনুস। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রাক্তনী’ ইউনুস জানিয়েছেন, ‘যাদবপুর আমার সেকেন্ড হোম, যা কিছু হয়েছি তাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। ফলে সেই প্রতিষ্ঠানে এমন কোনও ঘটনা যে অস্থির করে তুলবে, সেটাই স্বাভাবিক।’ অধ্যাপক ইউনুসের মতে, ‘যে ঘটনা ঘটেছে তা যাদবপুর কেন বিশ্বের যে কোনও প্রতিষ্ঠানে ঘটলে তা নিন্দনীয়। এই লজ্জা আমাদের সবার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে কিছু অবাঞ্চিত ফাঁকফোকড়ের জন্যই মর্মান্তিক এই ঘটনা। কোন আইনে প্রাক্তনীরা হস্টেল দখল করে থাকবে? কেন জুনিয়রদের র্যাগিংয়ের শিকার হতে হবে? কর্তৃপক্ষ কেন সব জেনেও চুপ করে থাকল? আজ ঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিলে ছেলেটা বেঁচে যেত।’ ইউনুসের এও দাবি, ‘পড়ুয়ার মৃত্যুকে হাতিয়ার করে কিছু রাজনৈতিক দল যেভাবে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তা বিস্ময়কর। রাজনীতি নয়, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই ঘটনাকে দেখা উচিত।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন গার্গী উওম্যান কলেজের অধ্যাপক বলেন, ‘যে কোনও অকালমৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তবে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কালিমালিপ্ত করা, রাজনীতি করা অনুচিৎ।’
যাদবপুরকাণ্ডের সূত্রে দিল্লির জেএনইউ’র অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ধর বলেন, ‘এটা সত্যিই চিন্তার বিষয় যে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে এই ধরনের র্যাগিং হয়েছে, সেটা অসম্ভব নিন্দনীয়। এটা কোনওভাবেই মানা যায় না। আমার প্রশ্ন হল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন সজাগ ছিলেন না? এই ধরনের র্যাগিং তো হয় ক্যাম্পাসে, তারা কি সেটা বুঝতে পারেননি নাকি জানতেন না? অনেকবেশি চোখ কান খোলা রাখা উচিৎ ছিল তাঁদের। অবশ্যই কর্তৃপক্ষের তরফে একটা গাফিলতির বিষয় আছে। ক্যাম্পাসে র্যাগিং বিরোধী সংস্কৃতি তৈরি করা, প্রচার প্রসার চালানো অত্যন্ত জরুরি এবং শুধু পড়ুয়ারা নয়, তাদের অভিভাবকদেরও এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা অতি আবশ্যক।’ বিশ্বজিৎবাবুর মতে, ‘এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিক গোটা দেশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নির্মূল হোক র্যাগিং নামের অভিশাপ।’ দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই মৃত্যু দুর্ভাগ্যজনক। কোনওমতেই সমর্থন করা যায় না। যাদবপুরের মতো দেশের প্রথমসারির বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা, ভয়াবহ। এই র্যাগিং কালচার অবিলম্বে সারা দেশে বন্ধ হওয়া দরকার।’