- কল্লোল মজুমদার
তৃতীয় দফার ভোটে এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী থাকল মালদা। যে ঘটনা শুধু রাজ্য-রাজনীতিতে নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাটি কালিয়াচক ১ নম্বর ব্লকের সিলামপুর ৩ নম্বর বুথে। ভোট দিয়ে বেরিয়ে এক ভোটদাতা অভিযোগ করেন, ইভিএমে যে বোতামই টিপুন, ভোট চলে যাচ্ছে পদ্ম প্রতীকে৷ ওই ভোটারের দাবি, ভোটদানের পর ভিভিপ্যাটের স্লিপ দেখে তিনি এই অভিযোগ করেছেন। আরেক ভোটদাতা একই কথা বলেন। পরে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে এই অভিযোগ জানার পর দ্রুত ব্যবস্থা নেয় নির্বাচন কমিশন।
ওই ভোটদাতারা ভিভিপ্যাট স্লিপ দেখে বিষয়টি জানান প্রিসাইডিং অফিসারকে। অভিযোগ জানানোর পর পালটে দেওয়া হয় ইভিএম। এ নিয়ে বিতর্ক চরমে। হতেই পারে যান্ত্রিক ত্রুটি। যা বলার চেষ্টা করে ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার নতুন ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু করান। এই ঘটনাটি একটি উদাহরণ মাত্র। ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকে অভিযোগের শেষ নেই, প্রশ্ন অনেক।
নিঃসন্দেহে ইভিএমের ব্যবহার নির্বাচন পরিচালনাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি নানা প্রশ্নও উঠছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক দিন থেকে ব্যালট পেপারে ফেরার পক্ষে সওয়াল করছেন। মুম্বইয়ে কয়েক মাস আগে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের মঞ্চ থেকে বহু নেতা ইভিএম সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। রাহুল গান্ধি বলেছিলেন, ‘রাজার আত্মা ইভিএমে।’
ইভিএম নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়েছে। যদিও সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট ভিভিপ্যাট গণনা বাধ্যতামূলক করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। তবে ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি করেছে। সে যাই হোক, ইভিএম বিতর্কের উৎস খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে।
সে সময় প্রাক্তন আইএএস কান্নান গোপীনাথন একটি কেন্দ্রের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন। তিনি নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানান, ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) এবং ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেল) অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁর নির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল, ইভিএম বা ভিভিপ্যাট ম্যালওয়্যার ব্যবহার করে বিকৃত করা যেতে পারে। গোপীনাথন নির্বাচন কমিশনের কাছে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছিলেন। এরপর কান্নানের অভিযোগটি নিয়ে আরও তদন্তের জন্য প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে পাঠায় কমিশন।
২০১৭ সালে বাধ্য হয়ে কমিশনের তরফে ইভিএম চ্যালেঞ্জ বা হ্যাকাথন আয়োজন করে সমস্ত রেজিস্টার্ড রাজনৈতিক দলকে নিয়ে। যদিও ভোটদাতা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতো ‘স্টেক হোল্ডার’দের তাতে শামিল করা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে মাত্র দুটি এনসিপি এবং সিপিএম শুধু ওই আয়োজনে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষার ক্ষেত্রে কমিশন নানা শর্ত আরোপ করায় ওই দলগুলিও শেষ পর্যন্ত সেই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
সিপিএম মনে করে, ইভিএম-এর সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ না করে এবং কেবলমাত্র একটা বোতাম টিপে বা বহিরাগত ওয়্যারলেস ডিভাইস ব্যবহার করে কোনও ইভিএম হ্যাক করা যাবে কি না বোঝা যাবে না। এনসিপি কমিশনের কাছে ইভিএমের মেমোরি চিপ এবং ব্যাটারি নম্বরের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিল। কমিশন জানায়, সেটা সম্ভব নয়। যে কারণে কমিশনের ওই অনুশীলনকে ‘আই ওয়াশ’ আখ্যা দিয়েছিল এনসিপি।
সেই বিতর্ক এখনও চলছে। রাহুল, মমতা ও ইন্ডিয়া জোটের অন্যান্য নেতার পর কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা দিগ্বিজয় সিং সম্প্রতি দাবি করেছেন, ইভিএমে নির্বাচন পরিচালনার ব্যাপারে কান্নানের উত্থাপিত বিষয়গুলি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের অবশ্যই প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত।
কান্নান গোপীনাথন ইভিএম সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তুললেও কমিশনের সন্তোষজনক উত্তর পাননি। বিরক্ত হয়ে কমিশনের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘আমি আমার কোনও বক্তব্যে ভুল করে থাকলে তবে আপনার দায়িত্ব রয়েছে আমাকে প্রতিহত করা এবং আমাকে ভুল প্রমাণ করা যাতে আমি মিথ্যা প্রচার না করতে পারি। কিন্তু আমি যা বলছি, তার সত্যতা থাকলে স্বীকার করুন এবং ত্রুটি সংশোধনের জন্য পদক্ষেপ করুন।’
মালদার ঘটনার পর গোপীনাথনের সেই দাবি ফের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল।