নকশালবাড়িঃ বাবা এক সময় রিকশা চালাতেন, মা পরিচারিকার কাজ করে ছেলেদের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। সেই ছেলে আজ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে চাকরিতে যোগদান করছেন। সোমবার দার্জিলিং এসপি অফিসে চাকরিতে যোগদান করতে চলেছেন নকশালবাড়ির ছেলে ধনঞ্জয় গিরি। নকশালবাড়ি স্টেশন পাড়ার বাসিন্দা ধনঞ্জয় গিরি(২৫) পশ্চিমবঙ্গ সাব ইন্সপেক্টর নিয়োগ ২০২০ পরিক্ষায় পাশ করেছেন। নকশালবাড়ি থেকে একমাত্র ধনঞ্জয় এই পরিক্ষায় পাশ করেছেন। তাকে নিয়ে গোটা এলাকায় খুশির আমেজ। অনেকের কাছেই ধনঞ্জয় এখন অনুপ্রেরণা। তবে কনস্টেবল থেকে এস আই হওয়ার পথ যে খুব একটা সহজ ছিল না তা এদিন ধনঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলেই জানা গেল।
নকশালবাড়ি স্টেশন পাড়ার প্রেমনগরের বাসিন্দা বাদল গিরির ছোট ছেলে ধনঞ্জয় গিরি। ৬৫ ছুঁই ছুঁই বাদলবাবুর নিজের ভিটেমাটি বলতে কিছু ছিল না। রেলের জমিতে থেকেই তিন ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন বাদল গিরি এবং তার স্ত্রী বনবালা গিরি। সারাদিন নকশালবাড়িতে রিকশা চালিয়ে যা আয় হত তা দিয়েই একবেলার পেটের ভাত জোগার হত। দিশা না পেয়ে সর্বশেষে নকশালবাড়ির একটি আদার গদিতে কাজ করতে শুরু করলেন স্বামী স্ত্রী দুজনেই। সারাদিন আদার গদির কাজ সেরে পরিচারিকার কাজ করতেন বনবালা দেবী। এভাবেই স্বামী স্ত্রীর টাকায় তিনবেলার খাবার জোগার করতেন তারা।
বাবা মায়ের সেই কষ্টের কথা শুনতেই চোখে জল পড়তে শুরু করল ধনঞ্জয়ের। বাবা মায়ের সেই কষ্টের ফল পেয়েছেন তাঁর তিন ছেলেই। তিন ছেলেই এখন আর বাবা মাকে কাজে যেতে দেয় না। বড় ছেলে রতন গিরি এখনও টিউশন পড়ায়। মেজো ছেলে দীপক গিরি জেল পুলিশের ওয়ার্ডার পদে রয়েছে। ছোট ছেলে ধনঞ্জয় গিরিও চাকরী পেলেন পশ্চিমবঙ্গ পুলিশে।
ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন ধনঞ্জয়। বিনা কোচিংয়ে তিনি এসআই পরিক্ষায় সাফল্য পেয়েছেন। অবশ্যই চাকরির পরিক্ষার প্রস্তুতিতে শিক্ষক হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন দুই দাদাকে। ২০১৯ সালে নকশালবাড়ি কলেজ থেকে ইতিহাস অনার্সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রুপোর পদক পেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। তারপরেই রতন গিরি এবং ধনঞ্জয় গিরি দুই দাদার পরামর্শে বাড়িতেই চাকরির পরিক্ষার প্রস্তুতি শুরু করেন তিনি। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ কনস্টেবল এবং জেল ওয়ার্ডার পুলিশ দুই পরিক্ষায় পাশ করেন। ৯ মাস জেল ওয়ার্ডার পুলিশে চাকরি করার পর ছেড়ে দেন। পরে একই বছরে কনস্টেবলের চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু পড়াশোনা ছেড়ে দেননি। ২০২০ সালেই এসআই চাকরির পরিক্ষা দেন। ২০২৩ সালে সেই পরিক্ষায় পাশ করেন ধনঞ্জয়। পাশাপাশি কলকাতা পুলিশের এসআই পদেও পাশ করেছেন তিনি।
ধনঞ্জয় বলেন, ‘আমি ডিউটি শেষে রাতের দিকে পড়াশোনা করতাম। প্রশিক্ষণ চলাকালীন যখন আইনের ক্লাস হত তখন আমি নিজের বইপত্র পড়তাম। নিজে কোনদিন বইপত্র কিনতাম না। দাদারা সব সময় চাকরির পরিক্ষার পিডিএফ আমাকে পাঠাত। সাহস দিত। তা দিয়েই পড়াশোনা করতাম। এখন পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেব। বড় দাদা রতন গিরি এখনও সেই ভাঙা চোরা বাড়িতেই টিউশন পড়ায়। তিনি বলেন, গ্রামেগঞ্জে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় না। এই জন্য অনেক ছেলে মেয়ে হাল ছেড়ে দেয়। ইচ্ছা থাকলে এবং পড়াশোনা করলে কেউ আটকাতে পারে না আমার ভাই তা দেখিয়ে দিয়েছে।
ধনঞ্জয়ের বাবা বাদল বাবু বলেন, সারা জীবন রেলের জমিতে থেকেছি। সব সময় একটা আতঙ্ক থাকত কখন উঠিয়ে দেবে। তখন পরিবার নিয়ে কোথায় যাব সেই আতঙ্কে দিন কাটিয়েছি। দুই ছেলে চাকরি করে নিজের পায়ে দাড়িয়েছে। এখন আর কোন আতঙ্ক নেই।