Sunday, May 12, 2024
HomeTop Newsপ্রতিকূলতা পদে পদে, ডাক্তারিতে তিন বাগান-কন্যা, বিরল নজির চা বলয়ে     

প্রতিকূলতা পদে পদে, ডাক্তারিতে তিন বাগান-কন্যা, বিরল নজির চা বলয়ে     

নাগরাকাটাঃ রবার্ট ব্রুসের কথা মনে আছে? যিনি একশোবারের চেষ্টায় মাকড়সার জাল বোনা দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, অধ্যবসায় ছাড়া জীবনে সাফল্য অসম্ভব। ওঁরাও বোধহয় একই উপলব্ধি করেছিলেন। আর তাই নিষ্ঠা ও লক্ষ্যে অবিচল থেকে প্রমাণ করে দিলেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই।

ওঁরা মানে ডুয়ার্সের চা বাগানের তিন কন্যা। ওঁদের প্রত্যেকের গল্পটা অনেকটা একইরকম। হাজার প্রতিকূলতা পদে পদে। কিন্তু তা সত্ত্বেও চা বাগানের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় থেকেও যে স্বপ্নের জাল বোনা যায় তা দেখিয়ে দিলেন রীতা লামা, নিধি লামা ও শোয়নাম লামা। কালচিনি ব্লকের এই তিন কন্যা এবার একসঙ্গে নিট পাশ করে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ওঁদের সাফল্যে এখন বুক ভরে উঠছে ডুয়ার্সবাসীর। ওঁরাও চোখে স্বপ্ন আঁকছেন ভবিষ্যতের। আর্তের সেবায় নিজেদের কাজে লাগানোর।

রীতার বাড়ি ভাটপাড়া চা বাগানের বি ডিভিশনের টপ লাইনে। ওঁর বাবা বিক্রম লামা ওই বাগানেরই শ্রমিক। মা রাধিকা গৃহবধূ। দম্পতির ৪ ছেলেমেয়ে। সবচেয়ে ছোট রিতাই। ২০১৮ সালে নাগরাকাটার একলব্য মডেল স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন বীরপাড়ার একটি বেসরকারি স্কুলে। সেখান থেকে ৮৮ শতাংশ নম্বর নিয়ে আইএসসি পাশ করার পর প্রাণী বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে শিলিগুড়ি কলেজ থেকে এবার তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছেন। এই ফাঁকে নিটে বসেই বাজিমাত করেছেন পড়াশোনা অন্তপ্রাণ মেয়েটি। তবে সাফল্য একবারে আসেনি। তিন-তিনবারের চেষ্টায় ডাক্তারিতে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ‘জয়’ পেয়েছেন। কাউন্সেলিংয়ের পর ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন রীতা। অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র স্বভাবের ওই কন্যা বলছেন, ‘ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব। দু’বার ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়িনি। বাকিদেরও বলব স্বপ্ন ছুঁতে গেলে আপ্রাণ প্রচেষ্টার কোনও বিকল্প নেই।’

কালচিনি চা বাগানের আউট ডিভিশনের বুকেনবাড়ির নিধির সাফল্যও দ্বিতীয়বারের চেষ্টায়। জয়গাঁর একটি বেসরকারি সিবিএসই বোর্ডের স্কুল থেকে ২০২২ সালে ৮৮ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পাশ করেছিলেন নিধি। ডাক্তারিতে ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটাকেই একমাত্র লক্ষ্য করে কলেজেও ভর্তি হননি। রীতার মতো নিধিও এবার নিট পাশ করে উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস-এর প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। নিধির বাবা নয়নদীপ ছোটখাটো ঠিকাদারির কাজ করেন। মা সঞ্জু লামা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। তাঁদের একমাত্র সন্তানের সাফল্যে দম্পতির চোখে আনন্দাশ্রু। তাঁরা বলছেন, ‘অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করাচ্ছি। তবে সমস্ত কৃতিত্ব মেয়েরই। পড়াশোনার প্রতি ওর সংকল্পই আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।’ নিধি ও সেই একাগ্রতাকেই সাফল্যের ইউএসপি মানছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘একাগ্রতা ও অধ্যবসায় থাকলে যে কেউ নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে বলেই বিশ্বাস করি।’

মেচপাড়া চা বাগানের ৮ নম্বর আউট ডিভিশনের গুম্বা লাইনের শোয়নমের পড়াশোনা বারবিশার জওহর নবোদয় বিদ্যালয় থেকে। শোয়নমও ২০২২ সালে সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় ৮৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করেন নিট পাশ করাকেই। সেজন্য নিধির মতো শোয়নমও কলেজমুখী হননি। মেয়েটির বাবা কৈলাস লামা বাগানের শ্রমিক। দীপা আশাকর্মী। এক দাদা রয়েছে তাঁর। শোয়নম কলকাতা মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ভবিষ্যতে তাঁর ইচ্ছে, ডাক্তার হয়ে দুঃস্থ মানুষের সেবা করার। শোয়নমের কথায়, ‘নিজের এলাকা ও সমাজের জন্য যদি কিছু করতে পারি তবে সেটাই হবে বড় পাওনা। এখন পড়াশোনাটা মন দিয়ে করতে চাই।’

চা বাগান থেকে ডাক্তার হওয়ার নজির নেই এমনটা নয়। কিন্তু একই ব্লক থেকে একবারে তিন কন্যার এমন সাফল্য মনে করতে পারছেন না কেউই। আসলে বাগান এলাকা থেকে যেভাবে একের পর এক মেধা উঠে আসছে, তাতে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে আগামী প্রজন্মও। আর রীতাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধিরাও।

কালচিনির বিধায়ক বিশাল লামা বলছেন, ‘খবরটা শুনেই ভাটপাড়ার রীতাকে সংবর্ধনা দিয়েছি। অন্য দুটি মেয়ে এখন বাড়িতে নেই। ওদের সঙ্গেও দেখা করব। আমার শুভেচ্ছা রইল।’

সদ্য রাজ্যসভার সাংসদ মনোনীত হয়েছেন আলিপুরদুয়ারের শীর্ষ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা প্রকাশ চিকবড়াইক। তিনিও চা বাগান এলাকারই বাসিন্দা। প্রকাশ বলছেন, ‘জেলার ৩টি চা বাগান থেকে ৩ কন্যা ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর চেয়ে গর্বের বিষয় আর কীই বা হতে পারে। ওঁদের যে কোনও প্রয়োজনে পাশে থাকব।’

আশায় বুক বাঁধছেন রীতা, শোয়নমদের পড়শিরাও। আর মাত্র কয়েক বছরের অপেক্ষা। তারপর ঘরের মেয়েরা ফিরবে ডাক্তার হয়ে, আপাতত সেই অপেক্ষাতেই দিন গুনবেন তাঁরা।

Sandip Sarkar
Sandip Sarkarhttps://uttarbangasambad.com/
Sandip Sarkar Reporter based in Darjeeling district of West bengal. He Worked in Various media houses for the last 22 years, presently working in Uttarbanga Sambad as Sr Sub Editor.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

IPL | ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই বধ কেকেআরের, প্লে অফের টিকিট নিশ্চিত কলকাতার

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ইডেন গার্ডেনসে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে হারিয়ে আইপিএলের প্লে অফে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিল কেকেআর(KKR)। এদিনের খেলায় টসে জিতে বোলিং করার...

Asansol | আম কুড়োতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, বজ্রাঘাতে মৃত্যু বিজেপি কর্মীর ছেলের

0
বারাবনি: বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির অদূরে আম কুড়োতে গিয়ে বজ্রাঘাতে মৃত্যু হলো এক বিজেপি কর্মীর ছেলের। শনিবার বিকেলে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে আসানসোলের বারাবনি থানার খড়াবড়...

Maynaguri | অভাবের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নজির কৃতী পড়ুয়ার, উচ্ছ্বসিত গোটা গ্রাম

0
ময়নাগুড়ি : দারিদ্র্যের মাঝেও নজির প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়ার। ময়নাগুড়ি ব্লকের পানবাড়ি এলাকার ভবানী হাই স্কুলের ছাত্রী রুমা রায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৬০ নম্বর পেয়ে...

Siliguri | শিলিগুড়িতে রাতে প্রবল বর্ষণ, কিছু জায়গায় দাঁড়ালো জল

0
শিলিগুড়ি : অবশেষে প্রবল বৃষ্টি শিলিগুড়িতে। যার ফলে ব্যহত হল শহরের রাতের নগর জীবন। মনে করালো নববর্ষের সন্ধ্যে রাতের কথা। আজ রাতে বৃষ্টি হয়েছে...

Darjeeling | দার্জিলিঙে হেনস্তার শিকার সমতলের গাড়িচালকরা, ছড়াচ্ছে ক্ষোভ

0
শিলিগুড়ি: নির্দিষ্ট পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করলেও জরিমানা করছে দার্জিলিং(Darjeeling) ট্রাফিক পুলিশ। পাশাপাশি লালকুঠি, হাওয়া ঘর সহ একাধিক জায়গায় গাড়ির চাকার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে...

Most Popular