রাহুল মজুমদার, শিলিগুড়ি : পলিউশন সার্টিফিকেটের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। বিমার পাশাপাশি ফিটনেস সার্টিফিকেটেও সমস্যা রয়েছে। টায়ারের অবস্থা খুবই খারাপ। দীর্ঘদিন ধরে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার রাস্তা গড়িয়ে সেগুলির এমনই হাল যে স্ক্রু-ড্রাইভারের মতো শক্ত কিছু দিয়ে চাপ দিলে তা অনায়াসেই সেই টায়ারের ভিতরে ঢুকে যায়। চমকানোর আরও আছে। দেখা যাচ্ছে যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন, তাঁর হয়তো সেই গাড়ি চালানোর সরকারি শংসাপত্রই নেই। গাড়ির প্রকৃত চালক হয়তো অসুস্থ। নিজের অনুপস্থিতিতে ডিউটি করতে তিনি ভাই বা পরিবারের কাউকে হয়তো ওই গাড়ি চালাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। কোনওমতে গাড়ি চালাতে শেখা সেই ভাই বা পরিবারের সদস্যটি শহরের যানজটে বড়সড়ো গাড়ি নিয়ে দিব্যি নেমেও পড়েছেন। সম্প্রতি স্কুলবাস ও পুলকারের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমে ট্রাফিক পুলিশের আধিকারিকরা এমনই বহু অনিয়মের বিষয়ে জানতে পেরেছেন। এবিষয়ে টেলিফোনে শিলিগুড়ির ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) অভিষেক গুপ্তার সঙ্গে যোগযোগ করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ফোনে কিছু বলব না। অফিসে এলে কথা বলব।
সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে এখন বেশিরভাগ অভিভাবকই স্কুলবাসের ওপর ভরসা করেন। চালক এবং সহযোগীর ভরসায় পড়ুয়ারা স্কুলে যায়। কিন্তু সেই বাস কতটা সুরক্ষিত, গাড়ির বিমা, ফিটনেস বা পলিউশন সার্টিফিকেট ঠিক রয়েছে কি না সে বিষয়ে অভিভাবকদের কেউই কোনও খোঁজখবর নেন না। অভিযোগ, এই সুযোগেই এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অনিয়মের বহর বাড়ছে। শিলিগুড়ি শহরে সরকারি এবং বেসরকারি স্কুল মিলিয়ে ৩০০-রও বেশি বাস রয়েছে। এর বাইরে বেশ কিছু পুলকারও রয়েছে। মহকুমাকে হিসেবে জুড়লে এই সংখ্যা ৭০০ পার হবে। অভিযোগ, এই গাড়িগুলির বেশিরভাগই বিমা, ফিটনেস বা পলিউশন সার্টিফিকেট ছাড়াই চলছে। একাধিক বাসের টায়ারের অবস্থা খুবই খারাপ। বেশিরভাগ বাসে নিরাপত্তার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই।
২০১৬ সালের ২২ অগাস্ট লরির সঙ্গে একটি বেসরকারি স্কুলবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল। ১৫ জন ছাত্রছাত্রী গুরুতর জখম হয়। বাসগুলি মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনায় পড়ে। সাইকেল আরোহীকে বা বিুদ্যতের খুঁটিতে ধাক্কা মারাটা তো রোজকার বিষয়। নিয়ম ভাঙার খেলায় পুলকারগুলি আরও এগিয়ে অভিযোগ, এগুলির বেশিরভাগই অতিরিক্ত সংখ্যক পড়ুয়াকে নিয়ে যাতায়াত করে। ২০১৮ সালের ৯ মে এমনই এক পুলকার ১১টি শিশুকে নিয়ে যাতায়াতের সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফাঁসিদেওয়ার কাছে তিস্তা সেচ ক্যানালে পড়ে যায়। স্থানীয় ছয় যুবক ক্যানালে ঝাঁপিয়ে ওই পড়ুয়াদের পাশাপাশি চালককে বাঁচিয়েছিলেন।
ছুটির পর স্কুলবাসগুলি পড়ুয়াদের নিয়ে বের হওয়ার পর যেন অলিখিত রেসে মেতে ওঠে। কখনও একই স্কুলের বাস, কখনও বা অন্য স্কুলের বাসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। এর জেরে দিনে যে কতবার ট্রাফিক আইন ভাঙে তার ঠিকঠিকানা থাকে না। গত মাসের শেষের দিকে নিউ জলপাইগুড়ি ট্রাফিকের তরফে শিলিগুড়ির তিনবাত্তি মোড় সংলগ্ন এলাকায় স্কুলবাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। সেই অভিযানে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের ছয়টি বাস আটক করা হয়েছিল। বাসগুলিতে ফিটনেস, পলিউশন সার্টিফিকেটের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সমস্যা ছিল। বেশ কয়েকটির ট্যাক্স সংক্রান্ত সমস্যা ছিল। চালকরা তাঁদের পরিবর্তে প্রক্সি দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন, তাও তখন জানা যায়। বেসরকারি স্কুলগুলি বেশিরভাগই এজেন্সি দিয়ে বাস চালায়। কর্তৃপক্ষ সরাসরি এজেন্সির কাজে নাক না গলানোয় নিয়ম ভাঙার প্রবণতা বাড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সবকিছু জানার পর থেকে অভিভাবকদের একাংশ এ বিষয়ে মুখ খোলা শুরু করেছেন। হাকিমপাড়ার বাসিন্দা সৌগত সরকারের ছেলে শিলিগুড়ির দাগাপুরের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তাঁর বক্তব্য, স্কুলবাসেই ছেলেকে স্কুলে পাঠাই। যা শুনছি তাতে সবারই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আশ্রমপাড়ার মুন সরকারেরও একই বক্তব্য। তিনি বললেন, আগে পুলকারে পাঠালেও মেয়েকে এখন বাসেই স্কুলে পাঠাই। ওদের নিরাপত্তার স্বার্থেই সবার সতর্ক হওয়াটা খুব দরকার।