- অর্ক ভাদুড়ি
১
২০১৯ সালের সুদান। স্বৈরশাসক ওমর আল-বশির সদ্য ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। দেশজুড়ে বইছে গণ আন্দোলনের ঝড়। তার মধ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। জনগণ ক্ষুব্ধ। তাঁরা চান সেনাশাসনের অবসান। চান গণতন্ত্র।
রাজধানী খার্তুমের বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের মুখে পূর্ণ গণতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান। আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিপুল সংখ্যায় আছেন সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা। তাঁরা দলে দলে বেরিয়ে এসেছেন কারখানা ছেড়ে৷ রাজধানীর স্কোয়্যারগুলিতে চলছে উত্তপ্ত আলোচনা, তর্কবিতর্ক- কেমন করে তৃণমূল স্তর থেকে গড়ে তোলা যায় জনগণের শাসন? প্রকৃত গণতন্ত্রের স্বরূপ কী? কয়েকটি এলাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ গড়ে তুললেন বিপ্লবী কমিটি-জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখল, ‘১৯১৭ সালে জার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যেমন ছিল রাশিয়ার অবস্থা, ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রায় একই রকম পরিস্থিতি সুদানের খার্তুমে।’
সেই অভ্যুত্থানের তিন বছর পর এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় সুদানের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুহম্মদ মুখতার আল খাতিব আমায় বলেছিলেন, ‘বিপ্লবী পরিস্থিতি আর বিপ্লবের মধ্যে যে দূরত্ব, তা ঘুচিয়ে দিতে একটি সেতুর প্রয়োজন। সেই সেতুটির নাম লেনিন। ১৯১৭ সালের রাশিয়ায় একজন লেনিন ছিলেন। ছিল লেনিনীয় মডেলে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টি। ২০১৯ সালের খার্তুমে বিপ্লবী পরিস্থিতি থাকলেও উপযুক্ত শক্তি নিয়ে ছিল না তেমন কোনও দল। ছিলেন না একজন লেনিন। তাই আমরা পারিনি।’
২
২০২৩ সালের কলম্বো। এক বছর আগেই রাজাপাক্ষে বিরোধী ঐতিহাসিক গণ অভ্যুত্থানে উত্তাল হয়েছে দ্বীপরাষ্ট্র। সর্বশক্তিমান শাসককে পালাতে হয়েছে প্রাসাদ ছেড়ে। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ঢুকে পড়েছেন প্রাসাদে। তাঁরা জলকেলি করেছেন সুইমিং পুলে, সেলফি তুলেছেন সিংহাসনসদৃশ বিলাসবহুল চেয়ারে বসে। প্রায় অলৌকিক সব দৃশ্যমালা উল্কার মতো দ্বীপরাষ্ট্রের আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে সর্ন্তপণে। সনৎ জয়সূর্যের দেশে আমি গিয়েছি অভ্যুত্থানের এক বছর পর পরিস্থিতি ঠিক কেমন তা খতিয়ে দেখতে।
প্রবল বৃষ্টির মধ্যে এক সকালবেলায় ছোট একটি জিপে করে চলেছি রাজধানী থেকে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্বের একটি গ্রামে। আমার ঠিক পাশেই বসে রয়েছেন আইনজীবী নুয়ান বোপেগে, শ্রীলঙ্কার ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা। যে আশ্চর্য সকালে এক বছর আগে হাজার হাজার জনতা সব বেড়া ভেঙে ঢুকে পড়েছিল রাজাপাক্ষের প্রাসাদে, সেই জনতাকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নুয়ান। সেদিনের গল্প শুনতে শুনতে প্রশ্ন করলাম, ‘কিন্তু তারপর কী হল? কেন বিদ্রোহ নিজেকে বদলে ফেলল না বিপ্লবে?’ নুয়ান হাসলেন। বললেন, ‘আমাদের কোনও লেনিন ছিলেন না, যিনি কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভের দ্বিধা চূর্ণ করতে পারবেন বিপ্লবী স্পর্ধায়। আমাদের ছিল না পর্যাপ্ত শক্তি নিয়ে কোনও লেনিনীয় মডেলের পার্টি, যে নেতৃত্ব দিতে পারবে বিপ্লবী জনতার।’
খানিকক্ষণ পর যেখানে পৌঁছোলাম, সেটা একটা বাগানবাড়ি গোছের জায়গা। গাছপালা, পুকুর, খোলা জায়গা, বাগানের মাঝে একটা তিনতলা বাড়ি৷ জানলাম, বাড়িটা কোনও এক ধর্মীয় সংস্থার। তারাও রীতিমতো সক্রিয় গণ আন্দোলনে। দোতলায় একটা বিরাট হলঘর। তাতে গোল হয়ে বসে হরেক কিসিমের শ-দেড়েক মানুষ। কেউ বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, কেউ কট্টর কমিউনিস্ট, কেউ খ্রিস্টান পাদ্রি, কেউ ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, কেউ মানবাধিকার কর্মী। একসঙ্গে বসে তাঁরা আলোচনা করছেন কেমন করে গড়ে তোলা যাবে নতুন আন্দোলন। পরিকল্পনা হচ্ছে গ্রামে, শহরে অসংখ্য পিপলস কাউন্সিল গড়ে তোলার। নুয়ান বললেন, ‘এই আমাদের সোভিয়েত। এই কাউন্সিলগুলিতে থাকবে সব মত ও পথের প্রতিনিধিত্ব। আমরা, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীরা এর মধ্যে নিয়ে যাব বিপ্লবের প্রচার। রাশিয়ায় ঠিক যে কাজ করেছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন।’
৩
দেড় মাসও হয়নি আর্জেন্টিনার ক্ষমতায় বসেছেন অতি দক্ষিণপন্থী প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের মিলেই। ইতিমধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজপথ। আগামী ২৪ জানুয়ারি দেশজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন আর্জেন্টিনার শ্রমিকরা। প্রতিদিন বুয়েনস আয়ার্সে রাস্তা প্লাবিত হচ্ছে শ্রমিক আন্দোলনে। সেই মিছিলের ভিড়ে আছেন লেনিন৷ ওয়ার্কার্স লেফট ফ্রন্টের কর্মীরা বিরাট ভূমিকা পালন করছেন আন্দোলনে। তাঁদের অন্যতম নেতা গ্যাব্রিয়েল সোলানো বলছিলেন, এই তীব্র সংকটে তাঁদের অন্যতম অনুপ্রেরণার নাম ভ্লাদিমির ইলিচ, যিনি হাতেকলমে শিখিয়েছিলেন কেমন করে তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মাত্র ১২ বছরে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় বিপ্লবের দিকে।
লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল প্যালেস্তাইনের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট গেরিলা পিএফএলপি’র কর্মীদের সঙ্গে। ৩০ বছরের আব্বাস বলছিলেন, প্যালেস্তাইনের মুক্তির প্রশ্নে লেনিন তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একশো বছরেরও বেশি আগে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। তবে একইসঙ্গে দেখিয়েছিলেন, বিপ্লবী সমাজতন্ত্রীদের কাজ শুধু সেখানেই থেমে থাকতে পারে না। আব্বাসের কথায়, ‘জায়নবাদীদের কবল থেকে প্যালেস্তাইনকে মুক্ত করা আমাদের প্রাথমিক লড়াই। তার পরের ধাপ লেনিনের শিক্ষার ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক প্যালেস্তাইন গড়ে তোলা। মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়া অন্য শক্তিগুলির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানেই।’
এই লেখা যখন লিখছি, ঠিক তখনই নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড স্তব্ধ হয়ে রয়েছে ধর্মঘটে। অফিস-কাছারি, কলকারখানা, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। শূন্যেরও কিছুটা নীচে তাপমাত্রা। তারমধ্যেই হাজার হাজার শ্রমিক মিছিল করছেন রাজপথে। তাঁদের একাংশের হাতে লেনিনের ছবি৷ কয়েকদিন আগে ধর্মঘট করলেন লন্ডনের টিউব রেলের শ্রমিকরা। তাঁদের নেতা বরিস গর্ডন গাইলেন, ‘অ্যাট দ্য কল অফ কমরেড লেনিন…’। শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাস। সুইডেনে টেসলার কারখানায় চলছে শ্রমিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সংহতিতে সংগঠিত মিছিলে লেনিনের ছবি। ফ্রান্সে একইসঙ্গে অতি ডানপন্থীদের পাশাপাশি উত্থান হচ্ছে বামপন্থার। ফরাসি শ্রমিক মিছিলে লেনিনের ছবি৷ ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনেও যেমন ছিলেন লেনিন। গ্রিসে মূলধারার বামপন্থীদের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি নতুন করে ফেটে পড়ছে শ্রমিক বিক্ষোভ। লন্ডনে প্রতি সপ্তাহান্তে হাজার মানুষের মিছিলের পাশে বিরাট পোস্টারে লেখা ‘বিপ্লবের উৎসব’, সঙ্গে লেনিনের ছবি। তিব্বত সীমান্ত লাগোয়া নেপালি গ্রামে গিয়ে আমি দেখেছি মালবাহকদের বৈঠক। দেওয়াল থেকে সেই বৈঠকে নজর রাখছেন লেনিন। ইরানের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের ভিড়ে মিশে থাকা, মরতে মরতেও না মরা তুদে পার্টির সমর্থকদের বুকে লেনিনের ব্যাজ। বেইরুটে হাতেকলমে চলছে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি, সেখানে বক্তৃতা করছেন লেবানিজ সমাজতন্ত্রী নাদের, তাঁর মুখে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে লেনিনের শিক্ষা। চিলিতে, ভেনেজুয়েলায়, ব্রাজিলে, কলম্বিয়ায় বিরাট বিরাট শ্রমিক মিছিলে লেনিনের ছবি, আজও। পর্তুগালে লাখো মানুষের আভান্তে উৎসবেও লেনিন। সেন্ট পিটার্সবার্গ আর লেনিনগ্রাদ নেই, কিন্তু লেনিন রয়ে গিয়েছেন রাশিয়ায়। এখনও তিনি বিপুল জনপ্রিয়। গোটা দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের মধ্যে আছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। এই ‘থাকা’র স্বরূপ সর্বত্র এক নয়। এক এক দেশে এক এক রকম।
৪
বিশ শতকের চশমায় একুশ শতককে দেখা যায় না৷ ঠিক যেমন ঊনবিংশ শতকের চশমায় ভ্লাদিমির লেনিন বিশ শতকের রাশিয়াকে দেখেননি। লেনিনকে পড়তে হবে একুশ শতকের বাস্তবতায়। তাঁর সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে পরবর্তীকালের মার্কসবাদীদেরও। যেমন রোজা লুক্সেমবার্গ। বিংশ শতাব্দীর অনেকগুলি দশক তাঁকে নিয়ে তেমন চর্চা হলই না। অথচ তিনি কথা বলেছিলেন সমাজতন্ত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আমলাতন্ত্রের বিপদ নিয়ে, চেয়েছিলেন গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ুক, কমুক কেন্দ্রিকতার জমি। লেনিন ও রোজা- দুই মহান বিপ্লবীর তর্কবিতর্ককে তাঁদের প্রয়াণের পর অনেকগুলি দশক ‘লেনিন বনাম রোজা’ করে রাখা হল। অথচ যা করার কথা ছিল ‘লেনিন এবং রোজা’। তাতে আরও সমৃদ্ধ হতে পারত লেনিনবাদ। সুখের কথা, মার্কসের মতো লেনিনকেও নতুন করে পড়া শুরু হয়েছে বিশ্বজুড়েই। লেনিনের সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথনের মাধ্যমেই এগোচ্ছেন একুশ শতকের বিপ্লবীরা। কখনও তাঁরা লেনিনের সঙ্গে একমত হবেন, কখনও খানিকটা ভিন্নমত।
( লেখক সাংবাদিক। লন্ডনের বাসিন্দা)