মিঠুন ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: ভোট বড় বালাই। তাই ভোট ঘোষণা হতেই মন্দিরে মন্দিরে ঢল পড়ে যায় নেতা-প্রার্থীদের। দেবতার চরণে মাথা ঠুকে সকলের যেন একটাই প্রার্থনা, ‘এবারের মতো উতরে দাও ভগবান!’ বড় বড় মন্দির তো বটেই, পাড়ায় পাড়ায় হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মন্দিরেও এখন পুজো দেওয়ার হিড়িক ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের। তাই খাটুনি বেড়েছে পুরোহিতদের। কখন কোন নেতা আসেন, এই আশায় দিনভর পড়ে থাকতে হচ্ছে মন্দিরে মন্দিরে। কিন্তু লাভের লাভ! তা অবশ্য কিছুই হয়নি। কারণ দক্ষিণা হিসেবে যা মিলছে, তার সবটাই চলে যাচ্ছে মন্দির কমিটির খাতায়। তাই মুখ বড় ব্যাজার পুরোহিতদের।
শান্তিনগরের বাসিন্দা পেশায় পুরোহিত সুদীপ আচার্য মনে করছেন, ‘নেতারা মন্দিরে যাচ্ছেন জনগণের মন পেতে। বহু মন্দিরে স্থায়ী পুরোহিত নেই, থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দক্ষিণার উপর মন্দির কমিটিগুলোর অধিকার থাকে। সামান্য যজমানি করে ভালো দিনের আশা করাই বৃথা।’ ভোটই আসল সময়, যখন নিজেদের দাবি তুলে ধরা যায় নেতাদের কাছে। কারণ বছরের বাকি দিনগুলিতে তাঁদের আর সেভাবে দেখা যায় কোথায়! কিন্তু পুরোহিতদের দুর্দশা শোনার কেউ নেই। আবার শুনলেও সমস্যা মেটানোর উদ্যোগ কারও নেই।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বহু পুরোহিতের অভিযোগ, সরকার তাঁদের জন্য ভাতা ঘোষণা করেছে। কিন্তু প্রকৃত পুরোহিতদের বেশিরভাগই সেই ভাতা পাচ্ছেন না। শুধু ‘ব্রাহ্মণ’ পদবি হওয়ার কারণে অপুরোহিত অনেকেই ভাতা পাচ্ছেন। দিন পনেরো আগেই শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ পুরোহিত উন্নয়ন সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানেও এইসব দাবিতে সরব হয়েছিলেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পুরোহিতরা।
এ প্রসঙ্গে সংগঠনের সভাপতি বিকাশ রায় বললেন, ‘পুরোহিতরা এখন কার্যত মন্দির কমিটিগুলোর কর্মচারীতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণার উপর কমিটিগুলো দখল নিয়েছে। সারা বছর নিয়মিত কাজ থাকে না। বহু অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ এমনকি কোটি টাকা খরচ করা হয়, কিন্তু পুরোহিতের বরাদ্দ কিন্তু খুব একটা বাড়েনি।’
রাজগঞ্জ ব্লকের হরি আচার্য, স্বরজিৎ চক্রবর্তীর মতো অনেকেরই সরকারি ভাতা মিলছে না। ইসলামপুরের বাসিন্দা চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘নেতাদের মন্দিরে যাওয়ার সঙ্গে ধর্ম-কর্মের কোনও সংযোগ নেই। তাঁরা এলাকায় আসার আগে স্থানীয় ক্যাডারদের থেকে সেখানকার সমস্যা শুনে নিয়ে বুলি আউরে চলে যান। তাতে সমস্যা মেটে কতটা সেটা বিগত দিনের নেতাদের প্রতিশ্রুতি ও দলের ইস্তাহারের দিকে চোখ রাখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়।’
অনেকের মতে, বর্তমানে এই পেশায় থেকে সম্মান বজায় রাখা মুশকিল। সঙ্গে অন্য কিছু না করলে অভাব নিত্যসঙ্গী। ফলে নতুন প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় আসতে চাইছে না। শিলিগুড়ির এক পুরোহিত বলছিলেন, ‘কিছুদিন আগে এক যজমানের পিতৃবিয়োগ ঘটে। রাতের বেলায় আমি গিয়ে ঘাটকাজ করাই। পরবর্তীতে অন্য একজন পুরোহিতকে দিয়ে শ্রাদ্ধকর্ম করানো হয়। এই বিষয়ে আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে গালে চড় জুটেছিল। তখন থেকে সন্তানরা আর পুজোআচ্চা করতে দিতে চাইছে না।’