প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, নয়াদিল্লি: কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির বিদেশ সফর এবং শাসকদলের বিরুদ্ধে বিদেশের মঞ্চে বিষোদগার প্রসঙ্গে বিতর্ক অব্যাহত। এবার রাহুলের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নামল বিজেপি। ‘হিংসার বাজারে ভালোবাসার দোকান খুলতে এসেছি’- রাহুলের এই চিরাচরিত উক্তির বিরুদ্ধে সরব হয়ে প্রাক্তন ওয়ানার সাংসদকে এবার খোলা চিঠি লিখলেন তিন বিজেপি সাংসদ-কর্ণেল রাজ্যবর্ধন রাঠোর, পুনম মহাজন এবং প্রবেশ সিং ভার্মা। রাহুলের প্রতি তাঁরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, ‘ভালোবাসার দোকান’ বলে আসলে রাহুল যা ঢাকতে চাইছেন, তা ‘হিংসার মেগা মল’! ৯ পাতার সুদীর্ঘ চিঠিতে বিজেপি সাংসদরা দাবি করেছেন, কংগ্রেস এবং গান্ধি পরিবারের ইতিহাস উলটে দেখলে প্রকৃত ‘ভালোবাসা’র অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে, যার আড়ালে রয়েছে সন্ত্রাস, রক্তপাত, অধিকারহরণ, প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার মিশেল।
তাঁদের যুক্তির সপক্ষে, জওহরলাল নেহেরু শাসনকালে ১৯৪৮ সালে গান্ধি হত্যার পরে মহারাষ্ট্রে অসংখ্য মানুষকে (অধিকাংশ হিন্দু মহাসভা সদস্য) হত্যা করার ঘটনা, ইন্দিরা গান্ধির আমলে ১৯৬৬-তে সংসদ ভবনের বাইরে গো রক্ষা আন্দোলনকারী সাধুসন্তদের উপর গুলিবৃষ্টি করা, ১৯৭৫-এ সারা দেশে ‘জরুরি অবস্থা’র ঘোষণা, আশির দশকে আলমোরা ও ফিরোজাবাদে দলিত হত্যা, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পর সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে শিখ গণহত্যার অভিযোগ তুলে ধরা হয় এই চিঠিতে। পাশাপাশি, দলের নেতাদের সঙ্গে গান্ধি-নেহরু পরিবারের ভেদাভেদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের অন্ত্যেষ্টিতে নেহরুর উপস্থিত না হওয়া, ভীমরাও অম্বেদকরের প্রতি অন্যায় অবস্থান, ইচ্ছাকৃত তাঁকে লোকসভা নির্বাচনে হারতে দেওয়া, গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরী-কে জেলবন্দি করা, প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরীকে চূড়ান্ত ‘অপদস্ত’ করা অথবা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা পি ভি নরসিমা রাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ কংগ্রেস সদর কার্যালয়ে প্রবেশ না করতে দেওয়া, এমন অসংখ্য ঘটনার কথা ‘খোলা চিঠি’তে তুলে ধরেছেন রাঠোর, মহাজন ও ভার্মা। এই চিঠিতে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে চরম অবিচার প্রদর্শনে, তাঁর ভারতরত্ন প্রাপ্তির সময়ে উপস্থিত হননি সনিয়া বা রাহুল গান্ধি, সে কথার উল্লেখও করা হয়েছে। এরই সঙ্গে গুলাম নবী আজাদের বহিষ্কার, মল্লিকার্জুন খাড়গেকে নানা বিষয়ে ভর্ৎসনা, পরিবার সদস্য মানেকা গান্ধিকে বহিষ্কার, বরুণ গান্ধির বিবাহে গান্ধি পরিবারের অনুপস্থিতির মতো একাধিক অনুচ্চারিত অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে এই চিঠিতে। কংগ্রেস জমানায় বিভিন্ন স্ক্যাম, দুর্নীতি, ঘোটালা, হাওয়ালার সমস্ত বিবরণ তুলে ধরে রাহুল গান্ধির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখা হয়, ‘এই যদি ভালোবাসার দোকানের নমুনা হয়, হিংসার বাজার তবে কী?’
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই আমেরিকা সফরে গিয়ে কংগ্রেস নেতা বলেন, ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে ব্রিটেনেও বক্তৃতা দিতে গিয়ে একই ধরণের মন্তব্য করেন তিনি। এহেন মন্তব্য করার জেরে রাহুলকে ক্ষমা চাইতে হবে, এই দাবিতে সরব হন কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীরা। যদিও নিজের অবস্থান থেকে সরেননি প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ। বৃহস্পতিবার এই বিষয়টি উল্লেখ করেই রাহুলকে তুলোধনা করেন স্মৃতি ইরানি। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসার কথা বলেন আপনারা। শিখদের হত্যার ঘটনাও কি তার মধ্যে পড়ে? রাজস্থানে মহিলাদের অপহরণও কি ভালোবাসা? হিন্দু মতে জীবন যাপনের বিরোধিতা করাকে কি ভালোবাসা বলে?’ স্মৃতি আরও বলেন, ‘আপনি ভালোবাসা নিয়ে এত কথা বলেন, তার জন্যই কি দেশের গণতন্ত্রে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দাবি করেন? দেশ নয়, নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের কথা বলেন। এটা কেমন ভালোবাসা?’
একই ইস্যুতে রাহুলের প্রতি কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়ে বিদেশমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের দাবি, ‘রাহুল গান্ধি যখনই দেশের বাইরে যান তখনই দেশের সমালোচনা করা এবং আমাদের রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে তাঁর। গোটা বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তারা কী দেখছে? নির্বাচন হয়, কখনও কখনও একটি দল জিতে যায় এবং অন্য কোনও সময় অন্য দল জিতে যায়। সব নির্বাচনের ফলাফল একই হয় না, আর দেশে গণতন্ত্র না থাকলে এমন পরিবর্তন সম্ভব নয়।’ তিনি এও বলেন, ‘আমরা তো জানি ২০২৪ এর ফলাফল কি হবে, কিন্তু আমার বক্তব্য তিনি দেশের অভ্যন্তরে যাই করুন না কেন, জাতীয় স্বার্থে জাতীয় রাজনীতিকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া আমি ঠিক মনে করি না।’ এই প্রসঙ্গে কংগ্রেসের লোকসভা দলনেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী পালটা সরব হয়ে জানান, বিদেশমন্ত্রী আগে থেকেই ২০২৪-এর ফলাফল নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করছেন। এর থেকে সহজেই অনুমেয় যে নির্বাচন কমিশনেও মোদি সরকার প্রভাব খাটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।