নয়াদিল্লি: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের প্রতি বিশেষ অনুরাগী। গত ন’বছরের শাসনকালে ৬০ বার তিনি উত্তর-পূর্বের রাজ্যে সফরে এসেছেন। কোভিড অতিমারি প্রভাব না থাকলে অনায়াসে ১০০ বার তিনি উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি পরিদর্শন করতেন। মোদির নির্দেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদীয় সদস্যরা এ যাবৎ প্রায় ৪০০ বার উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে উন্নয়ন এবং বিকাশের বার্তা বয়ে সফরে এসেছেন। শনিবার গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত ‘পূর্বোদয়’ প্রকল্পের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং’র এমনই মন্তব্য ঘিরে আবারও নতুন করে বিতর্কের মুখে পড়েছে বিজেপি সরকার।
প্রসঙ্গত, ৬০ দিনেরও বেশি সময় ধরে অগ্নিগর্ভ হয়ে আছে উত্তরপূর্বেরই অন্যতম রাজ্য মণিপুর। হিংসা এবং অশান্তির পাশে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত সেখানে। টানা আড়াই মাস ধরে মণিপুরে হিংসা চলতে থাকায় রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী এন.বীরেন সিংহ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই সার্বিক ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। এমনকি সম্প্রতি দিল্লিতে সর্বদলীয় বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মণিপুর মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফারও দাবি জানান সম্মিলিত বিরোধী শিবির। বীরেন্দ্র সিংহ নিজেও পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, যদিও শেষ পর্যন্ত নাটকীয়ভাবে তিনি প্রত্যাবর্তন করেন, বিজেপির কর্মী সমর্থকেরা তাঁর পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
অবশ্য এসবে প্রশমিত হয়নি মণিপুরজুড়ে হিংসার আগুন। গতকাল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির সফরকালেই পুনরায় উত্তপ্ত হয় মণিপুর, ফলস্বরূপ প্রাণ হারান দুই রাজ্যবাসী। মণিপুরের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রের ব্যর্থতা তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মৌনতা’ নিয়েও ক্ষুব্ধ বিরোধীরা। অন্যদিকে, ক্রমশ ‘নাগালের বাইরে’ চলে যেতে থাকা মণিপুরের স্পর্শকাতর আবহে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেছে কেন্দ্রীয় শিবির, যার ফলস্বরূপ গুয়াহাটিতে সরকারি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং’র কণ্ঠে ধ্বনিত হল উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলির প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রী তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষ আকর্ষণ এবং অনুরাগ।
এদিন জিতেন্দ্র সিং বলেন, ‘ন বছর আগে উত্তর পূর্ব রাজ্যগুলি সর্বদা প্রচারে থাকত দুঃসংবাদের কারণে। জাতিগত হিংসা, সংঘর্ষ, ছাত্র-বিক্ষোভ ও সীমান্ত সংকটের ঘটনা জাঁকিয়ে বসেছিল এই রাজ্যগুলিতে। মোদি জমানায় সেই পরিস্থিতিতে আসে আমুল পরিবর্তন। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি জুড়ে এখন শুধুই সমৃদ্ধি ও বিকাশ। উত্তরপূর্বের যুব ও তরুণ প্রজন্ম ভারতের সার্বিক উন্নয়নের পথের সঙ্গী।’ এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর মন্ত্রিসভায় সদস্যদের ঘন ঘন উত্তরপূর্বে আগমনের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেন, ‘২০১৪-২২ এ গত আট বছরে উত্তর-পূর্বের ১৩৫০টি প্রকল্পের জন্য ধার্য হয়েছে ১৫,৮৬৭ কোটি টাকা।‘ উত্তর-পূর্বের সমস্ত রাজ্যের সুখসমৃদ্ধিই মোদি সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে জানান জিতেন্দ্র সিং।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বক্তব্যকেই নিশানা করেছে বিরোধী শিবির। প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই দাবিদাওয়া নিতান্তই হাস্যকর। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায়, সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীরা ঘন ঘন উত্তরপূর্বে গেছেন, তাতে কী লাভ হয়েছে? মণিপুর জ্বলছে, অসমে সেনাদের গুলিতে মরছে সাধারণ মানুষ, অরুণাচলে দখল নিচ্ছে চিন। তাহলে উন্নয়ন কোথায়? প্রদীপবাবু বলেন, ‘উত্তরপূর্বের জন্য সরকার কী করেছে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে আগেই পরিষ্কার হয়েছে, এককথায় নিট ফল শূন্য। মোদি বা তাঁর মন্ত্রীরা যতই উত্তর-পূর্বে ঘুরুন না কেন; তাঁদের চেষ্টায় বিস্তর ফাঁকি। মণিপুর তার জ্বলন্ত প্রমাণ।’ বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতার কটাক্ষ, ‘এতই যদি উত্তরপূর্বের রাজ্যের প্রতি টান, তবে কেন প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যাচ্ছেন না? কেন মুখে কুলুপ এঁটে আছেন তিনি? অথচ রাহুল গান্ধি মণিপুরে শান্তির বার্তা নিয়ে গেলে তাঁকে আটকানো হচ্ছে।’
প্রদীপ ভট্টাচার্য এর সুরেই সুর মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভা সাংসদ, উত্তরপূর্বের ‘ভূমি কন্যা’ সুশ্মিতা দেব বলেছেন, ‘আসলে বিজেপি মণিপুর নিয়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত, ব্যর্থ। তারা জানে না কী ভাবে এই পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব৷ তাই মন ভোলানো কথা বলে মণিপুর থেকে সকলের নজর সরাতে চাইছে।’ সুশ্মিতা দেব এও বলেন, ‘মোদি জি এবং তাঁর মন্ত্রীরা কতবার উত্তর-পূর্বের রাজ্যে সফর করেছেন তা দেখিয়ে বিজেপি নিজেদের দোষ ঢাকতে চায়, মণিপুর প্রমাণ করে দিয়েছে এসব মিথ্যের স্তবক যা ক্রমশই খসে পড়ছে।’