- সন্দীপন নন্দী
চৈত্রের খরদুপুরে ঠাঁঠাঁ রোদ্দুরতলে বেগুনপোড়া হতে হতে ভাষণ শুনতে কার ভালো লাগে? তবু অহেতুক বকবক, অশ্রাব্য ব্যক্তি আক্রমণের কথামালা বাধ্য হয়ে শুনতেই হয়। সমর্থকদের যুগে যুগে ভোটদূত একথাই বলে যান। শুনবে কিন্তু মনে রাখবে না।
ফলে মাঠেঘাটে এইসময় এক আনুগত্যের দোলা লাগে। বাসে, বাজারে, ব্যাংকে, ময়দানে বিকেলের ভিড়গুলো ক্রমে মেনে নেওয়া মানুষের দখলে চলে যায়। কেননা সভাশেষে অভ্রভেদি হেলিকপ্টার উধাও না হওয়া পর্যন্ত পাথর হয়ে থাকার রুল জারি হয়েছিল পার্টি অফিসে। সঙ্গে দাদারা বলেছিল, অযুত বিপত্তি সামলেও দলের মহামিছিলে এগিয়ে যেতে হবে। ঘোর মনখারাপের দিনেও বিপক্ষের স্লোগান সাউটিং স্তব্ধ করে জাগিয়ে রাখতে হবে ধর্মতলা হতে কালীতলা।
ফলে কেউ চাকরির আশায়,কেউবা নদীসেতু নির্মাণের অঙ্গীকারপত্র প্রাপ্তির ইচ্ছায় আঠার মতো লেগে থাকবেন দলের সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ কর্মীর স্বীকৃতি দিতে দিনরাত তরুণদল একাকার হবে কেরল থেকে কালনা, মেঘালয় থেকে মালদার বুথে বুথে। এইসময় পাহাড় থেকে সমতলের নির্বাচন সভায় একজন প্রকৃত মানুষের নাম হয়ে উঠবে হোলটাইমার। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যারা মণিপুরেও আছে, খাসপুরেও আছে। রেজোলিউশনে লেখা থাকবে, এরাই দলের সম্পদ। কিন্তু দল সরকার গঠন করার কালে এই মণিমাণিক্যের গৌরবগাথা কোনওদিন লেখা হবে না। যেখানে কথা না রাখার দশটা ভোট পেরিয়েও যাদের হাসিমুখে গমগম করে পার্টি অফিসগুলো।
এদিকে গণ্ডগ্রামে একযুগ চাকরির কালবেলা কাটিয়েও ভোটের সকালে গৃহবন্দি থাকবেন কোনও সতীর্থ মহামানব। খবর হবে, সব কথা দলকে সমীপেষু করে অভিমানে বিচ্ছেদের পোস্ট দিয়েছেন জনৈক শাখা সম্পাদক। তারপর শত ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়েও নোটা নয়, ভালোবাসার ভোটে নাড়িয়ে দিয়েছেন এক বিক্ষুব্ধ ব্যালট ইউনিট। এ তো গল্প নয়, ভোটের রূপকথা মাত্র।
ভোট এলেই একটা ইচ্ছে আর অনিচ্ছের মাঝে সংবেদন জনমন চরকিপাক খায় প্রতিবার। আর ঠিক-বেঠিকের গন্ডা গন্ডা গ্রামার বইগুলো ঠোঙা হয়ে ঘুরতে থাকে নগরে প্রান্তরে। আর মনোনীত দলের ক্ষমতা দখলের সুসংবাদ আগমনের অপেক্ষায় সহসা শান্তসরল মানুষগুলো দলদাস হয়ে ওঠেন। দলের সবভালোর পক্ষপাতিত্বে জনে জনে গান্ধারী হতে চান।
দেখতে দেখতে চোখ, কান, স্বর সব কর্মক্ষমতা হারিয়ে এক প্রাপ্তমনস্ক মানুষ একবগ্গা অশিক্ষিত হয়ে উঠবে টিভি ডিবেটের সন্ধ্যায়। যা কিছু ভালো বা যা কিছু শুভ তার সঙ্গে অশুভ-অমঙ্গলের বিভেদ গড়ার ন্যূনতম অধিকারবোধটুকু হারিয়ে দিগভ্রান্ত পুতুল হয়ে ব্রিগেড ভরিয়ে তুলবেন কিছু লোক।
এটাই এক দেশে ফুরিয়ে আসা গণতন্ত্রের ফিরিস্তি। নমিনেশনের যে দিন থেকে ঘোষিত হয়, মাইকের অন্য নাম বিপ্লব, চিৎকারের অন্য নাম অধিকার। ফলে সর্বত্র চেয়ার দখলের অবিশ্বাস্য খেলায় মুখভাষ্য খেউরে রূপান্তরিত হলেও তাকে স্বাভাবিক বলে সেফজোনের পাঁচিল গড়ে তুলব। তখন হয়তো, বিপক্ষকে কলঙ্কিত করবার গর্জনকালে কোকিলও ভয় পেয়ে নীরব হবে। যে পলাশ আর শিমুলের বন একটা সুদৃশ্য হয়ে থেকে যেত ওই নদীপাড়ে কিংবা পাড়ার বকুল ভাণ্ডারের পাশে, সেখানেই ক’দিন পর ছেয়ে যাবে প্রকৃত প্রস্তাবের পনেরো ফুট পোস্টার। ফলে এক পূর্ণবসন্তকে মুছে দেবে প্রতিশ্রুতির কদাকার মিলনমেলা। যা শহরের হাসপাতাল আর সদ্য শোকের বাড়িঘরের অখণ্ড নীরবতা ভেঙে নেতাদের গান, খেলাগুলো গণতন্ত্রের কল্লোল যুগ হয়ে জেগে থাকবে। আমরা দেখব কিন্তু মনে রাখব না।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা। প্রবন্ধকার)