- গৌতম হোড়
শ্রীনগর আসার কিছুক্ষণ আগে প্লেন থেকে নীচে তাকালে চোখে পড়বে বরফে ঢাকা পাহাড়ের সারি। একের পর এক উচ্চাবচ শৃঙ্গ, যার রং কোথাও দুধসাদা, কোথাও কিছুটা ধূসর। শ্রীনগর শহর থেকেও আগের মতো চারপাশে বরফের পাহাড় দেখে মন ভালো হয়ে যায়। ডাল লেকের বিপুল জলরাশির পিছনে পাহাড়ের ল্যান্ডস্কেপ বড় সুন্দর লাগে।
এই সব কিছুই বদলায়নি, বদলানো সম্ভব ছিল না। ভোটের আগের কাশ্মীরে বদলের ছবিটা অন্যত্র। যা মালুম হল হোটেলের ঘর খুঁজতে গিয়ে। পরপর হোটেল সব ভর্তি। কোথাও ঘর নেই। যেগুলিতে আছে, তাতে চার থেকে পাঁচগুণ দাম চাইছে। ভোটকর্মী, আধিকারিক বা নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা নন, শ্রীনগর সহ কাশ্মীরের সর্বত্র পর্যটকদের ভিড়ে হোটেল ঠাসা। প্রতিটি দ্রষ্টব্য জায়গায় প্রায় দুর্গাপুজোর ভিড়। রাস্তাঘাটে ঘুরলেই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে বাংলায় কথাবার্তা। শ্রীনগরের আইকনিক লালচকের ক্লক টাওয়ারের থেকে সামান্য দূরে শাল, সোয়েটারের দরদাম করছিল একটা পরিবার। এসেছেন কলকাতা থেকে। কাশ্মীরের রূপে মোহিত হয়ে গিয়েছেন। বেড়াতে এসে কোনও অসুবিধার মধ্যে পড়েননি। যতটা পেরেছেন ভূস্বর্গের রূপ চোখ ভরে দেখে নিয়েছেন। মোহিত হয়েছেন। এখন যাওয়ার সময় এসেছে। এখন ভাবছেন, আবার আসবেন, তাড়াতাড়ি আসবেন।
শুধু বাঙালিরাই নন, গুজরাটি, অসমিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় পর্যটকে ভরে গিয়েছে কাশ্মীর। সরকারি আধিকারিকদের ধারণা, এই বছর রেকর্ড পর্যটক আসতে পারেন। যার সংখ্যাটা আড়াই-তিন কোটি ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। পর্যটকদের দেখে নিরাপত্তাবাহিনীও কিছু বলে না। তাঁরা মসৃণভাবে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন। কারণ এই পর্যটকরাই তো বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বড় বিজ্ঞাপন, বদলে যাওয়া কাশ্মীরের বিজ্ঞাপন।
তবে এই ছবির পাশাপাশি আরেকটা সত্য আছে। বিমানবন্দর থেকে শ্রীনগরের পথে যত এগোবেন, পরে ডাল লেক, ক্লক টাওয়ার থেকে শ্রীনগরের অলিতে-গলিতে যত ঘুরবেন, সর্বত্র দেখতে পাবেন একটু দূরে দূরে নিরাপত্তাবাহিনীর সশস্ত্র জওয়ানরা দাঁড়িয়ে। রাস্তায়, দোকানের সামনে, ভবনে, বাড়ির ছাদে সর্বত্র। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে চলে যাচ্ছে সিআরপিএফের সাঁজোয়া গাড়ি। কখনও একটা, কখনও পরপর তিন-চারটে। কিছু গাড়ির মাথায় বন্দুক হাতে সশস্ত্র জওয়ান। অন্য গাড়ির ছোট জানলা দিয়ে বেরিয়ে আছে বন্দুকের নল।
এই গাড়িগুলি যাওয়ার সময় রাস্তা আটকে দেয় পুলিশ। সেই গাড়ি আগে যায়, তারপর রাস্তা খোলা হয়। পাঁচ বছর আগে পুলওয়ামায় সিআরপিএফের গাড়িতে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। একটি বিস্ফোরকভর্তি গাড়ি এসে সোজা আঘাত করেছিল সিআরপিএফের গাড়িতে। ৪০ জন জওয়ান মারা গিয়েছিলেন। তারপর আর কোনও ঝুঁকি নেওয়া হয় না।
পুলওয়ামার সেই জায়গায় না বলে দিলে বোঝা যাবে না, সেখানে ওরকম একটা ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল। সেখানে যেতেই বুম দেখে সিআরপিএফের প্রশ্ন, কোথা থেকে আসছেন? দিল্লির সাংবাদিক জেনে বললেন, ঠিক আছে। সেই রাস্তার পাশেই নুর মহম্মদের ড্রাই ফ্রুটসের দোকান। পাঁচ বছর আগের কাশ্মীর এবং এখনকার কাশ্মীরের মধ্যে ফারাক কী? জবাব আসতে বেশি দেরি হল না। বললেন, ৩৭০ ধারা এখন আর নেই। কৃষকরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বছরে ছয় হাজার টাকা পাচ্ছেন। গরিবরা বিনা পয়সায় র্যাশন পান। পাঁচ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমার সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে। বয়স্ক ভাতা সোজা অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়ছে। এ সবই ভালো দিক। কিন্তু কাশ্মীরের যে বিশেষ পরিচয় ছিল, যে কাশ্মীরিয়ত ছিল, তার অভাব বোধ করছি।
কাশ্মীরে সিপিএমের পরিচিত নেতা হলেন ইউসুফ তারিগামি। বেশ কয়েকবার তাঁকে মারার চেষ্টা হয়েছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। তারিগামি মনে করেন, সন্দেহ নেই আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হয়েছে। কিন্তু তাঁর দাবি, এটাকে শান্তি বলা যাবে না।
তারিগামির সঙ্গে মিলে যায় কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিটির সভাপতি সঞ্জয় টিক্কুর মত। শ্রীনগরেই থাকেন টিক্কু। আক্রান্ত হওয়ার পর কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়ার হিড়িকের মধ্যেও তাঁর মতো কিছু পণ্ডিত থেকে গিয়েছেন। কার্পেট বিছানো ঘরের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত ভঙ্গিমার ছবি। রাম-সীতা থেকে মহাদেবের ছবিও সাজানো। সঞ্জয় টিক্কুর চাঁছাছোলা কথা, অবস্থা যদি এতটাই ভালো হয়, তাহলে পুলিশ মাঝেমধ্যে আমাদের কেন বলে, কয়েকদিন বাড়ি থেকে বেরোবেন না? অবস্থা যদি এতটাই ভালো হয়, তাহলে এত জওয়ান কেন চারপাশে? তারা না থাকলেও যদি কোনও ঘটনা না ঘটে, তাহলে বুঝতে হবে শান্তি এসেছে। টিক্কুর দাবি, গত কয়েক মাসে পাঁচটি পণ্ডিত পরিবার কাশ্মীর ছেড়ে চলে গিয়েছে।
ভোটের আগে বদলে যাওয়া কাশ্মীরে তাই পর্যটকরা আছেন, তারিগামি, টিক্কুরা আছেন, আবার আলতাফ ঠাকুররাও আছেন। আলতাফ হলেন বিজেপির নেতা। তিনি দাবি করলেন, উপত্যকায় এবার পদ্ম ফুটবে। মানুষ মুখে যাই বলুন না কেন, উন্নয়নের স্বাদ পাওয়া এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীর মোদির সঙ্গে থাকবে।
এক আধিকারিকের বক্তব্য, শ্রীনগরে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা কার্যত শূন্য। অন্য জায়গায় যে কিছু ঘটনা ঘটে না এমন নয়, তবে তার সংখ্যা খুব বেশি নয়। সীমান্তের কাছে কিছু উত্তেজনাপ্রবণ এলাকা আছে, সেসব বাদ দিলে কাশ্মীরে এখন হিংসার ঘটনা অনেকটাই কমে গিয়েছে।
কাশ্মীরে এবার ভোট হচ্ছে ৩৭০ ধারা বিলোপ, নিরাপত্তাবাহিনীর সক্রিয় উপস্থিতি, কড়া হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে। অতীতে অনেকবার ভোট বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে অথবা খুব কম ভোট পড়েছে। কিন্তু এবার সব রাজনৈতিক দল মনে করছে, মানুষ ভোট দেবে। প্রচুর ভোট পড়বে। ন্যাশনাল কনফারেন্সের ইমরান নবি ডর, পিডিপি-র মোহিত ভানরা মনে করেন, উপত্যকার মানুষ ভোটকে তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে।
এই প্রসঙ্গে একটা প্রচারের কাহিনীও বলা দরকার। পিডিপি নেতা মোহিত ভান গুলমার্গ জেলায় একটি গ্রামে প্রচারে গিয়েছেন। তার পিছনে আমরাও। দূরে বরফের পাহাড়। সামনে আপেল, আখরোট ও সর্ষের খেত। তার মাঝখানে উসরু বলে একটি গ্রাম। সেখানে গাড়ি রেখে সামান্য হেঁটে একটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। বড় একটা ঘরে জনা চল্লিশেক গ্রামবাসী। সিঁড়ি থেকে পুরো বাড়ি কার্পেটে মোড়া। ঘরের দেওয়ালে কাঠের অসাধারণ কাজ। জানলা দিয়ে দূরের বরফ-পাহাড় দেখা যাচ্ছে। মোহিতরা বললেন, কেন মানুষের ভোট দেওয়া উচিত এবং কেন পিডিপি-কে ভোট দেওয়া উচিত। একেবারে কথোপকথনের ভঙ্গিতে। গ্রামের মানুষও প্রশ্ন করলেন। পতাকা নেই, ব্যানার নেই, উত্তেজিত ভাষণ নেই। বদলে যাওয়া কাশ্মীর, নিরাপত্তার আগলে বাঁধা পড়া কাশ্মীর, পর্যটকদের কাশ্মীরে প্রচারও অভিনব।
এই ভোটের কাশ্মীরে আপনি সব পাবেন। উত্তেজনা, সাসপেন্স, নিরাপত্তা, সন্দেহ, ভয়, পর্যটক- সব।
(লেখক সাংবাদিক)