গৌরহরি দাস, কোচবিহার : কোচবিহার তথা উত্তরবঙ্গ থেকে এই প্রথম এক অনাথ নাবালিকাকে ‘ফস্টার কেয়ার’-এ পাঠানো হচ্ছে। কোচবিহারের মেয়েদের জন্য একমাত্র সরকারি হোম শহিদ বন্দনা স্মৃতি বালিকা আবাস থেকে ওই নাবালিকা কলকাতায় যাবে। নাবালিকাকে নেওয়ার জন্য দমদম থেকে ‘পালক’ বাবা-মা ইতিমধ্যেই কোচবিহারে পৌঁছেছেন। সমস্ত নিয়ম মেনে উত্তর চব্বিশ পরগনার পৃথ্বীজিৎ রায়চৌধুরি ও শিখা রায়চৌধুরি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ওই ১৩ বছরের নাবালিকাকে ফস্টার কেয়ারে নিয়ে যাবেন।
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (সিডবলিউসি) সূত্রে খবর, বৃহস্পতিবার সকালে নাবালিকাকে কোচবিহার জেলা প্রশাসনের তরফে ওই দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হবে। উত্তরবঙ্গে এর আগে শিশু দত্তক নেওয়ার বহু নজির থাকলেও কাউকে ফস্টার কেয়ারের জন্য পাঠানো হয়নি। রাজ্যেও এমন ঘটনা দ্বিতীয়। এর আগে মুর্শিদাবাদের হোম থেকে দুটি শিশুকে ফস্টার কেয়ারে পাঠানো হয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে সিডবলিউসি-র চেয়ারপার্সন মধুমিতা মণ্ডলের বক্তব্য, ‘আমাদের কমিটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রত্যেকটি শিশু যাতে একটি পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই প্রত্যেকটা শিশুকে আমরা একটা পরিবার দেওয়া বা পরিবারে পাঠানোর চেষ্টা করি।’
তাঁর সংযোজন, ‘ফস্টার কেয়ারের জন্য দম্পতি নির্বাচন করে রাজ্য সরকার। সেরকম ভাবেই সরকারি সমস্ত নিয়ম মেনে এক দম্পতি এদিন সিডব্লিউসিতে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আজ সব নথিপত্রের কাজও সম্পূর্ণ হয়েছে। বাচ্চাটিও খুশিতে রয়েছে। সে ওই পরিবারে যেতে ইচ্ছুক। শহিদ বন্দনা স্মৃতি বালিকা আবাস ও প্রশাসনের সকলের চেষ্টায় কাজটি সম্পূর্ণ হয়েছে।’
ফস্টার কেয়ার বিষয়টি কী? দত্তক নেওয়ার সঙ্গে পার্থক্যই বা কী? দত্তকের ক্ষেত্রে একটি শিশুর ওপর কোনও দম্পতির পুরোপুরি আইনি অধিকার থাকে। কোনও দম্পতির নিজের সন্তান যা যা আইনি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য, দত্তক নেওয়া সন্তানও সেই সব অধিকার পেয়ে থাকে। কিন্তু ফস্টার কেয়ারের ক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই কোনও আইনি অধিকার থাকে না। শুধুমাত্র শিশুটিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লালন-পালন করে থাকেন ‘পালক’ বাবা-মা। পুরো বিষয়টির ওপরে প্রশাসনের নজরদারি থাকে। পরবর্তী সময়ে সব নিয়ম মানলে শিশুটিকে দত্তক নিতে পারেন ওই দম্পতি।
চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি ও প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, অনেক সময় দেখা যায় যে সব নাবালক বা নাবালিকাদের বয়স একটু বেশি, তারা নতুন পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়ে তাই তাদের দত্তকের বদলে ফস্টার কেয়ারে পাঠানো হয়। পাঁচ বছরের বেশি বয়সী কোনও শিশুকে কোনও পরিবারে পাঠানো জন্য সেই শিশুর অনুমতির প্রয়োজন। ফস্টার কেয়ারের ক্ষেত্রে যে দম্পতি লালনপালন করবেন, তাঁরা প্রথমেই দত্তক নিতে পারেন না। এর জন্য তাঁদের শর্ট টাইম ফস্টার অথবা লং টাইম ফস্টারের জন্য আবেদন করতে হয়। এক বছরের নিচে হলে শর্ট টাইম ফস্টার, এক বছরের বেশি লালনপালনের জন্য লং টাইম ফস্টার। এই সময়সীমা দু’বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়। এই সময়ে কোনও শিশু তার পালক বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। যদি দেখা যায়, সেই শিশু যদি দুজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে ও খুশি রয়েছে, তাহলে ওই দম্পতি সেই শিশুকে দত্তক নেওয়ার জন্য ফের সরকারি নিয়ম মেনে আবেদন করতে পারবেন। দত্তকের সম্মতি মিললে শিশুটি ওই দম্পতির উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হবে, সম্পত্তির অধিকারীও হতে পারবে। কিন্তু ফস্টার কেয়ারে দু’বছর ধরে থাকলেও কোনও শিশু তার ‘পালক’ বাবা-মায়ের উত্তরাধিকারী বা সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না।
বুধবার পৃথ্বীজিৎ জানান, তাঁদের ২৭ বছরের ছেলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তিনি বলেন, ‘নভেম্বর মাসে বারাসাতে জেলা শাসকের দপ্তরে ফস্টার কেয়ারে শিশু নেওয়ার জন্য আবেদন করি। সমস্ত নথিপত্র তৈরি হওয়ার পর সল্টলেকে আমাদের দু’দিনের প্রশিক্ষণ হয়। এরপর আমাদের কোচবিহারের হোমে নাবালিকার কথা জানানো হয়।’ পৃথ্বীজিতের বক্তব্য, ‘জুন মাসে আমরা কোচবিহারে আসি। মেয়েটির আমাদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল। রাজবাড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় ঘোরে। খুব আনন্দে ছিল। এবার আমরা তাকে নিতে এসেছি। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে আমাদের হাতে দেওয়া হবে। তিস্তা-তোর্ষা এক্সপ্রেসে কলকাতায় রওনা দেব।’
বৃহস্পতিবার ‘পালক’ বাবা-মায়ের সঙ্গে সরকারি হোম শহীদ বন্দনা স্মৃতি বালিকা বাস থেকে রওনা দেয় নাবালিকা। একদিকে যেমন, নতুন বাবা মা ফিরে পাওয়ার আনন্দ অপরদিকে, দীর্ঘদিনের হোমের আবাসিকদের ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই কলকাতা রওনা দিল পঞ্চম শ্রেণির নাবালিকা। মেয়েটির পালক বাবা পৃথ্বীজিৎ রায় চৌধুরী ও মা শিখ রায় চৌধুরী বলেন, ‘এখন ওই আমাদের সব। ওকে নিয়েই আমরা বাঁচবো। ওকে আমরা নিজের মেয়ের মতো করে মানুষ করে তুলব। আশা করছি ওকে নিয়ে আমাদের স্বপ্নপূরণ হবে পাশাপাশি মেয়েও আমাদেরকে বাবা মায়ের মতোই ভালবাসবে।‘
নাবালিকা জানায়, নতুন বাবা মাকে পেয়ে তাঁর খুব ভালো লাগছে। সে খুব খুশি। পাশাপাশি হোম-এর আবাসিকদের ছেড়ে যেতে তাঁর কষ্টও হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে সিডাব্লুসি-র চেয়ারপার্সন মধুমিতা মণ্ডল বলেন, ‘এদিন নাবালিকাটি ওর পালক বাবা মার সঙ্গে কলকাতায় রওনা হলেন। মেয়েটি এরকম পরিবার পাওয়ায় আমরা খুবই খুশি। আমরা আশা করব আগামী দিনে এ ধরনের ঘটনা আরও বেশি করে হবে। মানুষ আরও বেশি করে এগিয়ে আসবে।‘