শুভঙ্কর চক্রবর্তী
একশো বছরেরও বেশি সময় আগে ‘কাজের লোক’-এর বর্ণনা দিয়েছিলেন সুকুমার রায়। লিখেছিলেন, ‘বাঃ আমার নাম বাঃ, বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা!’ এতদিন পর কবির সেই কাজের লোকের খোঁজ মিলেছে। গঙ্গার ধারে আমবাগান ঘেরা মালদার (Malda) কোতুয়ালিতে তাঁর বাস। তিনি আর কেউ নন, মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু) (Abu Hasem Khan Choudhury)।
প্রবাদে আছে, ‘যখন রোম পুড়ছিল, তখন সম্রাট নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’ ডালুর ভূমিকাও অনেকটা সেই নিরোর মতো। গঙ্গার ভাঙনে প্রতিবছর একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে মালদার মানচিত্র। হাজার হাজার বিঘা কৃষিজমি গিলে ফেলেছে নদী। পঞ্চনন্দপুর লাগোয়া কেবি ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় পুরোটাই নদীগর্ভে। কত বাড়ি, স্কুল, মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ যে তলিয়ে গিয়েছে তার হিসেব নেই। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে বীরনগর-১ ও ২, মিলকি, খাসকোল, গোপালপুর, ভূতনি, মহানন্দটোলা, বিলাইমারি এলাকা। যেভাবে প্রতিদিন ভাঙছে তাতে কয়েক বছরের মধ্যেই ওই এলাকাগুলিও গঙ্গায় মিশে যাবে৷ রতুয়া, মানিকচক, কালিয়াচক তো আছেই, ইংরেজবাজার ব্লকেও গঙ্গার পাড় ভাঙছে পাল্লা দিয়ে৷ মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, ফরাক্কা, ধুলিয়ানও গঙ্গার ভাঙনে বিধ্বস্ত৷ ভাঙন মালদার আর্থসামাজিক পরিকাঠামোয় বড় আঘাত হেনেছে। হাজার-হাজার মানুষ উদ্বাস্তু।
ইতিমধ্যেই আরও বড় বিপদের কথা শুনিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, ভাঙন ঠেকানো না গেলে ভবিষ্যতে মিশে যেতে পারে গঙ্গা ও ফুলহার। সেটা হলে গোটা মালদা জেলারই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই ডালুর। ছেলে না তিনি, কে ভোটে প্রার্থী হবেন কয়েকদিন আগে পর্যন্ত সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র চিন্তা। আর এখন কীভাবে ছেলেকে জেতানো যায় বাড়িতে বসে বসে সেই ছক কষছেন।
এখনকার কথা বাদ দিন। সেই অর্থে আগেও ভাঙন নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না ডালুর। লক্ষ-লক্ষ মানুষের সমস্যাকে জাতীয় স্তরে তুলে ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ। ভাঙন রোধে অর্থবরাদ্দের জন্য পাঁচ বছরে দিল্লিতে জোরালো দাবিও তুলতে পারেননি।
ডালু নতুন সাংসদ নন। এর আগেও তিনি দীর্ঘদিন সাংসদ ছিলেন। ইউপিএ আমলে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীও হয়েছিলেন। ফলে দিল্লিতে তাঁর যোগাযোগ খারাপ নয়। তাঁর দল লোকসভায় বিরোধী আসনে রয়েছে। তাঁর পাশের কেন্দ্রের সাংসদই বিরোধী দলনেতা। ফলে দলকে বুঝিয়ে মালদা, মুর্শিদাবাদের জন্য একসঙ্গে লোকসভায় ঝাঁপাতেই পারতেন ডালু। তাহলে হয়তো কেন্দ্রের নজর ঘোরানো যেত। সেই উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি তাঁকে।
১৫৯ দিন লোকসভা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মালদা দক্ষিণের সাংসদ। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস এবং ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ-এর সমীক্ষা অনুসারে পারফরমেন্সের ক্রমতালিকায় তাঁর নাম ৪১৯ নম্বরে৷ পাঁচ বছরে প্রশ্ন করেছেন মাত্র ১২টি। লোকসভায় হাতে গুনে পাঁচদিন, পাঁচটি বিষয় নিয়ে বলেছেন।
আর এদিকে, পাঁচ বছরে এলাকার মানুষজন তাকে পাঁচদিনও দেখেছেন কি না, বলতে পারছেন না। আপদে-বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সেভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেও দেখা যায়নি তাঁকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, জরুরি প্রয়োজনে তাঁর বাড়িতে ছুটতে হত। সেখানেও দেখা মিলত কার্যত বরাতজোরেই।
মালদা জেলার কুড়ি হাজার একরের বেশি জমিতে তুঁতের চাষ করা হয়। এরমধ্যে সব থেকে বেশি চাষ হয় কালিয়াচকের তিনটি ব্লকে। কয়েক লক্ষ মানুষের রুজিরোজগারের প্রধান ভরসা রেশম। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এনে রেশমশিল্পে উন্নয়ন নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করেননি ডালু। জেলায় রেকর্ড সংখ্যক বিড়ি শ্রমিক রয়েছেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাঁদের জন্যও কেন্দ্রের কাছে দরবার করতে দেখা যায়নি ডালুকে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন ফরাক্কা ব্যারেজ হাসপাতালকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আবু হাসেম। সেই কাজ খানিকটা এগিয়েও ছিল। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দ মেলেনি। কয়েকজন চিকিৎসক এলেও তাঁরা ফিরে যান। ওই হাসপাতাল বর্তমানে চিকিৎসক ও পরিকাঠামোর অভাবে ধুঁকছে। পরবর্তীতে হাসপাতালটির জন্য কোনও পদক্ষেপই করেননি সাংসদ।
ফরাক্কা ব্যারেজের জন্য অধিগ্রহণ করা কয়েকশো একর জমি এখন ফাঁকা পড়ে আছে। সেই জমিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প, কারখানা তৈরির প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গিয়েছিল। সেগুলি নিয়েও উচ্চবাচ্য করেননি ডালু। ব্যারেজের ফিডার ক্যানালের পশ্চিম অংশে কাটান এলাকায় রাস্তা ও সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেননি।
মালদার আম নিয়েও আশার কথা শোনা যায়নি তাঁর মুখ থেকে। আশ্বাস দিলেও ফল প্রক্রিয়াকরণ শিল্প তৈরিতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আনতে ব্যর্থ হয়েছেন গনি খানের ভাই। বলেছিলেন ঠিকই, তবে মালদা বিমানবন্দর চালু, স্বাস্থ্য কাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ নিয়ে আসা, সবেতেই ব্যর্থতাই সঙ্গী হয়েছে তাঁর। ঐতিহাসিক মালদার পর্যটনের বিকাশের চেষ্টাতেও গত পাঁচ বছরে গোল্লা পেয়েছেন তিনি। আসলে বরকত সাহেবের প্রতি মালদাবাসীর দুর্বলতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে ব্যবহার করে দিব্যি ভোট বৈতরণি পার হয়ে গিয়েছেন তিনি। তাই হয়তো কাজ নিয়ে মাথা ঘামাননি।
গঙ্গার ভাঙনের মতো মালদায় গনি-মিথে ভাঙন ধরেছে। বরকত সাহেবের কৃতিত্বকে হাতিয়ার বানাতে গিয়ে কচলে তেঁতো করে ফেলেছেন কোতুয়ালির সদস্যরা। ভোটের গঙ্গায় ভেসে গেলে আঁকড়ে ধরার মতো খড়কুটোও আর অবশিষ্ট নেই তাঁদের কাছে।