Monday, April 29, 2024
Homeরাজ্যদক্ষিণবঙ্গগণেশ নয় কার্তিকের পাশে কলাবউ, প্রাচীন রীতি মেনে দুর্গা পূজিত হন বর্ধমানের...

গণেশ নয় কার্তিকের পাশে কলাবউ, প্রাচীন রীতি মেনে দুর্গা পূজিত হন বর্ধমানের সভাকর বাড়িতে

প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমানঃ পণ্ডিত মশাই সঠিক ভাবেই পুজো করাচ্ছিলেন। কিন্তু আকন্ঠ ‘কারণ সুধা’ পান করে পুজো করতে বসে পূর্ব পুরুষ বলে যাচ্ছিলেন বামে গণেশায় নমঃ, দক্ষিণে কার্তিকেয় নমঃ। তা শুনে পণ্ডিত মশাই প্রতিবাদ করেন ঠিকই। কিন্তু তন্ত্রসাধক ওই পূর্ব পুরুষ বাস্তবেই তখন সবাইকে দুর্গা প্রতিমায় গণেশ ও কার্তিকের স্থানবদল চাক্ষুষ করিয়ে ছিলেন।সেই থেকে ৩০০ বছরেরও বেশী সময়কাল ধরে বামে গণেশ ও দক্ষিণে কার্তিককে অধিষ্ঠিত রেখেই পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের সাদিপুর গ্রামের সভাকর বাড়িতে তৈরি হয় দুর্গা প্রতিমা। দেবী পক্ষে তন্ত্রমতে সেই প্রতিমারই পুজো পাঠ হয়। সভাকর বাড়ির এই পুজো ঘিরেই দুর্গোৎসবের কটা দিন মাতোয়ারা থাকেন  সাদিপুর গ্রামের বাসিন্দারা।

দামোদর নদ লাগোয়া জামালপুরের বেরুগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রাম সাদিপুর। সনাতন ঐতিহ্য মেনে এই গ্রামের সভাকর বাড়ির সাবেকি মন্দিরে হয় দেবী দুর্গার আরাধনা। সভাকর পরিবারের বর্তমান বংশধর দেবাশীষ চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁদের পূর্ব পুরুষ ছিলেন বল্লাল সেন, লক্ষণ সেনের আমলের লোক। বর্গিদের অত্যাচারে নিজ ভূমি ছেড়ে পূর্ব পুরুষরা পালিয়ে চলে আসেন সাদিপুর গ্রামে। সেখানেই তারা বসবাস শুরু করেন।

দেবাশীষ বাবুর কথায় জানা যায়, তাঁদের বংশের আদি অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন কালি। বংশে কালি পুজোর সূচনা কাল আরও বহু প্রাচীন। তবুও  মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তাঁদের বংশের পূর্ব-পুরুষ উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় কালি বেদিতেই দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। হতদরিদ্র সাধক ব্রাহ্মণ উমাচরণ বনের পুকুরের জল, বনের ফুল, চালতার আচার আর থোড়ের নৈবেদ্য দিয়ে দুর্গা মায়ের পুজো করতেন। সেই একই রীতি মেনে বাংলার ১১১১ সন থেকে আজও বর্তমান বংশধররা পুজো করে আসছেন।

সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজোর অনেক কাহিনী আজও বংশের লোকজনের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কথিত আছে বহুকাল পূর্বে বন্যার সময়ে দামোদরে পাটাতন সহ দুর্গা প্রতিমার একটি কাঠামো ভেসে আসে। স্থানীয় নাকড়া গ্রামের বর্গক্ষত্রিয় ধারা পরিবারের কয়েকজন সদস্য দামোদর থেকে সেই কাঠামোটি তুলে আনেন। তারা সেই প্রতিমা কাঠামোটি দূরের দেবীপুর এলাকায় বিক্রী করতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ মেনে তারা ওই কাঠামো আর দেবীপুরে বিক্রী করতে যান না। তারা পাটাতন সহ ওই কাঠামোটি হতদরিদ্র সভাকর পরিবারের বিধবা বধূ রতনমণি দেবীকে দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, পূর্ব পুরুষ উমাচরণ বাবুর সময়কালে একদল ডাকাত এক রাতের মধ্যে কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার একটি মন্দিরও তৈরি করে দেয়।

ওই কাঠামোতে দুর্গা প্রতীমা তৈরি করে মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালার মন্দিরে উমাচরণ দুর্গা পুজো শুরু করেন। তবে সেই সময়কার কাঁচা মাটির দেওয়াল ও খড়ের চালার মন্দিরটি এখন আর নেই। সভাকর বংশের বংশধররা পরে এখন ওই একই জায়গায় একটি সুন্দর পাকা দালান মন্দির তৈরি করেছেন। এখন সেখানেই পুজো হয়ে আসছে। তবে প্রতীমা কাঠামো দেওয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরুপ সেই সূচনা কাল থেকে আজও প্রতিবছর দুর্গা পুজোয় নাকড়ার বর্গক্ষত্রীয় ওই ধারা পরিবারে বর্তমান বংশধরদের নৈবেদ্য পাঠান সভাকর পরিবারের সদস্যরা।

পুজোর সূচনার ইতিহাস যেমন বৈচিত্রে ভরা তেমনি বৈচিত্র রয়েছে সভাকর বাড়ির দুর্গা প্রতিমায়। সাবেকি আমলের সেই একচালার কাঠামোয় আজও দুর্গা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। তবে এই সভাকর বাড়িতে দুর্গা প্রতিমায় সাধারণ রীতির  ঠিক বিপরিত অবস্থানে দেখা যায় গণেশ ও কার্তিক কে।এই বাড়ির প্রতিমায় গনেশ দেবী দুর্গার ডানদিকে না থেকে বাম দিকে অবস্থান করেন। আর কার্তিক বামদিকের পরিবর্তে ডানদিকে অবস্থান করেন। তবে কলা বউকে দুর্গা প্রতিমার ডানদিকে অর্থাৎ কার্তিকের পাশে রেখেই পুজো হয়। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অবস্থানে অবশ্য কোন পরিবর্তন নেই। এই বাড়ির প্রতিমায় দুর্গার বাহন সিংহ সাদা বর্ণের। তার মুখটি আবার ঘোড়ার মুখের ন্যায়। রায়নার মহেশ পালের পরিবার পুরুষানুক্রমে সভাকর বাড়ির এমন ব্যতিক্রমী মূর্তি তৈরি করে আসছেন।

স্থানীয় পূজারী মাণিক মুখোপাধ্যায় বলেন, পূর্বে বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা মন্দিরে কামান দাগার শব্দ শুনতে পাবার পর সভাকর বাড়িতে মহাষ্টমির সন্ধি পুজোর বলিদান হত। সেই সব এখন ইতিহাস। বর্তমানে পঞ্জিকার সাময় সারণী ধরে বলিদান হয়। দশমির দিন দধিকর্মা বিতরণ ও সিঁদুর খেলা পর্ব মিটে যাবার পর রাতে শোভাযাত্রা সহকারে দুর্গা প্রতিমা দামোদরে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন করা হয়। কোধ থিম ভাবনা ও আলোর রোশনাই হয়তো এ বাড়ির পুজোয় থাকে না। কিন্তু ভক্তিভাব ও নিজস্ব স্বকীয়তাতে সভাকর বাড়ির দুর্গা পুজো বিশেষ মাধুর্য বহন করে চলেছে।

Sandip Sarkar
Sandip Sarkarhttps://uttarbangasambad.com/
Sandip Sarkar Reporter based in Darjeeling district of West bengal. He Worked in Various media houses for the last 22 years, presently working in Uttarbanga Sambad as Sr Sub Editor.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

ISL | মধুর প্রতিশোধ যুবভারতীতে, ২-০ গোলে ওডিশাকে হারিয়ে আইএসএল ফাইনালে মোহনবাগান

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: টানটান উত্তেজনার ম্যাচে ওডিশাকে ২-০ গোলে হারিয়ে আইএসএলের ফাইনালে পৌঁছে গেল মোহনবাগান। ইনজুরি টাইমে জয়সূচক গোলটি করেন আব্দুল সাহাল। মোহনবাগানের...

AAP | আপের হয়ে দিল্লিতে প্রচারে অরবিন্দ পত্নী, ভিড় জমালেন মহিলারা

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: ‘যার স্বামী জেলে আছে, তাঁকে তো বাইরে আসতেই হবে’ কথাগুলি ৫২ বছরের কমলেশ জৈনের। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের স্ত্রী সুনীতা...

Titanic | নিলাম হল টাইটানিকের ধনকুবের যাত্রীর সোনার পকেটঘড়ির, দাম উঠল  ১০ কোটি

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্কঃ ডুবে গেলেও আজও জীবিত আছে মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায়। ১১০ বছরেরও বেশি জলের তলায় রয়েছে বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক। টাইটানিককে নিয়ে রয়েছে...

Siliguri | মাটিগাড়ায় হামলা, আক্রান্ত বিজেপির বুথ সভাপতি সহ ৬

0
শিলিগুড়ি: মাটিগাড়ার কলাইবক্তরি এলাকায় রবিবার সন্ধ্যায় একদল দুষ্কৃতী বিজেপির স্থানীয় বুথ সভাপতি নন্দকিশোর ঠাকুর সহ কয়েকজন বিজেপি কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা চালায়। যার জেরে দু’জন...

Migrant Worker | রমরমিয়ে চলা মাছের ব্যবসাই হল কাল, কেরালায় খুন হলেন মানিকচকের পরিযায়ী...

0
মানিকচকঃ কেরালায় গিয়ে মাছের ব্যবসায় ব্যাপক পসার জমিয়েছিলেন মালদার মানিকচক নাজিরপুরের একটি ছোট্ট গ্রাম লস্করপুরের যুবক প্রকাশ। স্বল্প লাভে মাছ বিক্রি করায় অল্প দিনের...

Most Popular