- অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
কথা দিলাম-বলে আসলে কোনও কথাই হয় না, এ কথা বুঝতে একটা গোটা জীবন ফুরায়, আর এ তো নিছক বসন্ত। লাইনগুলি লিখেছিলাম বহু বছর আগে, কবিতার খাতায়। আসলে সত্যিই কথা দেওয়া বা কথা রাখার দায় কারও থাকে না, থাকে শুধু হারিয়ে যাওয়ার একটা মন খারাপ। জীবনের প্রতিটি দিনের মুহূর্তের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কত কিছু। আমাদের চাওয়াপাওয়া ভালো লাগা খারাপ লাগার তোয়াক্কা না করেই।
কত বসন্ত আগে সেই যে দোলপূর্ণিমার একটা বিরাট চাঁদ উঠত সন্ধেবেলা, মায়ের কপালের বড় টিপটার মতো, আর স্নান সেরে দোলপূর্ণিমার সকালে ঠাকুরের সিংহাসনে ফোটো ফ্রেম হয়ে যাওয়া পূর্বজদের ছবিতে আবির দেওয়া হত! গোলাপি রঙের প্রভা আবির। কী সুন্দর একটা গন্ধ ছিল তার! সেদিন দেবদোল। মানুষের গায়ে আবির ছোঁয়ানো বারণ। পরদিন বড় বালতিতে রং গুলে পিতলের পিচকিরিতে রং ভরে বেলুনের গোলা তৈরি করা, বাড়ি বাড়ি রংয়ের অভিযান। হোলি হ্যায়! তখন কলকাতা দূরদর্শনে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব, সাদা কালো পর্দায়। শিমুলে পলাশে সেজে ওঠা বসন্তোৎসবের দৃশ্য।
তারপর কিছু কিছু নাচের স্কুল আর গানের স্কুলের আয়োজনে প্রচলন হল বসন্তবরণ, যা আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে অন্য শহরে। বাঙালি কিন্তু চিরদিনই হোলি খেলেছে, খুনি রং মেখে সাতদিন চিত্রবিচিত্র হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। রঙের ভয়ে বহু মানুষ ঘরে দরজা জানলা বন্ধ করেও থেকেছেন। জবরদস্তি রাস্তায় ধরে গায়ে রং ঢেলে দেওয়ার ঘটনাও কিছু কম ছিল না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে দোল উৎসব বসন্ত উৎসবের রূপ নেওয়ায় তার চরিত্রে একটা বড় পরিবর্তন এসেছে।
হ্যাঁ, যারা বিশুদ্ধ হোলি খেলায় বিশ্বাসী, মাইক বাজিয়ে ভোজপুরি গান চালিয়ে পিকনিক করে সিদ্ধি ভাঙের নেশায় রং বরসে ভিগে চুনারিয়া বা বালাম পিচকারি ধরনের উদ্দাম হোলি খেলায় অভ্যস্ত, তাদের চোখে এই বসন্ত উৎসব এক ধরনের সাংস্কৃতিক আদিখ্যেতা ছাড়া কিছুই নয়। যদিও তাদের অনেকেই বসন্তের কস্টিউম সাজে সেজে সোশ্যাল মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি বা মুহূর্ত ভাগ করে নিতে ভালোই বাসেন। আমি তো অন্তত এতে দোষের কিছু দেখি না। অন্যের শান্তি বিঘ্নিত না করে, অনিচ্ছায় রং না মাখিয়ে যদি একটা দিন আবিরের রঙে রঙিন হয়ে সবাই মিলে নাচেগানে আনন্দে বসন্ত বাতাসের সুরে সুর মেলানো যায়, তাহলে ক্ষতি কী? যা কিছু হারিয়ে গেল তাই প্রিয় ছিল আর যা নতুনের তাই-ই সমালোচনার এই মানসিকতায় বিচার করতে বসলে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করা যায় কি?
আসলে হয়তো এই উৎসবের দিনগুলো জাগিয়ে তোলে পুরাতন স্মৃতি ও গীতি। সমাজমাধ্যমে বা মেসেজ বক্সে ‘হ্যাপি হোলি’ শব্দবন্ধ আপনি আমি না চাইলেও কথ্য ভাষারই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনি না হয় খুব সুন্দর করে তার প্রত্যুত্তরে বসন্ত উৎসব বা দোলপূর্ণিমার শুভেচ্ছাই জানান। সুন্দর আকাশে তাকিয়ে দেখবেন, নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে বিশাল একটা সোনালি রঙের চাঁদ, সেই পুরোনো পৃথিবীর মতোই। হাতের মুঠোর উত্তাপে একটুখানি রং নিয়ে না হয় স্পর্শ রাখলেন প্রিয় মানুষটার কপালে। এই রং বদলের দুনিয়াতে একটা দিন সত্যিকারের ভালোবাসার রঙের হলে ক্ষতি কী! হোলি নাকি দোলপূর্ণিমা ভুলে লাল সবুজ কমলা রংগুলোর গা থেকে না হয় ক্ষমতার দখলদারি একদিনের জন্য মুছেই দিলাম!