- অমল সরকার
তিনটি প্রশ্ন, বলতে পারেন ধাঁধা দিয়ে এই লেখা শুরু করব। প্রশ্ন নম্বর এক, কোন সে বিষয় বা ইস্যু যা নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় অথচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দল নিজে থেকে কিছুই প্রায় বলছে না?
প্রশ্ন নম্বর দুই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদি এত কথা বলছেন, ভ্রষ্টাচার নিয়ে বলতে গেলে প্রায় রোজই বিরোধীদের শিরচ্ছেদ করছেন, সেই তিনি ঘুষ নিয়ে তাঁর কোন সে মিঠুনদা মার্কা ডায়ালগটি আর বলেন না?
প্রশ্ন নম্বর তিন, জানেন কি, গত দশ বছরে কোন খাতে খরচ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে?
হেঁয়ালি না করে মূল বিষয়ে আসি। তিনটি প্রশ্নই আসলে নির্বাচন সংক্রান্ত। নির্বাচনে কালো টাকার দাপট কমাতে মমতা একটা সময় নিয়ম করে বলতেন, ভোটের পুরো খরচ রাষ্ট্র বহন করুক। রাজনৈতিক দলগুলির ভোটের সময় টাকা নেওয়া বন্ধ করা দরকার। সেই তিনি ও তাঁর দল ইলেক্টোরাল বন্ড নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সবচেয়ে সংযমী। রাষ্ট্রীয় খরচে ভোটের কথাও সেভাবে শোনা যাচ্ছে না। প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসাবে জানিয়ে রাখি, ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে পাওয়া টাকার অঙ্কে তৃণমূল দেশে তৃতীয় স্থানে আছে।
নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। মিঠুন’দার ‘মারব এখানে…’-এর মতো ডায়ালগকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল মোদির সেই কথাটি। প্রধানমন্ত্রী কেন ডায়ালগটিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন, সে ব্যাখ্যা তিনিই দিতে পারবেন। তবে ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশের পর অনেকেই কথাটি কিঞ্চিৎ বদলে নিয়ে বলছেন- ‘জরুর খাউঙ্গা, খানে নহি দুঙ্গা’।
বন্ড বাবদ রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে জমা হওয়া ১৬ হাজার কোটির মধ্যে প্রায় অর্ধেক পেয়েছে পদ্ম পার্টি। অনেক পিছিয়ে দ্বিতীয় স্থানে কংগ্রেস। তাদের প্রাপ্য ১৭০০ কোটি। তৃণমূলের তৃতীয় স্থান অর্জন তুলনায় অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক। দুটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টিও এই ব্যাপারে জোড়াফুলের কাছে পিছিয়ে পড়েছে।
ইলেক্টোরাল বন্ড আমাদের মতো আমআদমির চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি। তবে ওই তথ্যটি জানার পর বন্ডের ছবিতে চোখ বোলালে আমার সেটি কর্পোরেট হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন বলে মনে হয়। তথ্যটি হল, ওষুধ কোম্পানিগুলি বিপুল টাকা ঢেলেছে ইলেক্টোরাল বন্ডে।
এবারে আসি তৃতীয় প্রশ্নের জবাবে। ২০১৪ থেকে ’২৪, এই দশ বছরে দেশে পাঁচ বছর অন্তর বেড়ে চলেছে নির্বাচনি ব্যয়। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের (সিএমএস) রিপোর্ট বলছে ২০১৪-তে খরচের অঙ্ক ছিল ৩০ হাজার কোটি। তা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয় ২০১৯-এ। ’২৪-এর সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার কোটি।
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের ব্যয় বড়জোর ২০ শতাংশ। বাকিটা রাজনৈতিক দলের খরচ। সিএমএসের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৯-এ খরচ হওয়া ৬০ হাজার কোটির ৪৫ শতাংশ বা ২৭ হাজার কোটি খরচ করে বিজেপি। দেশের প্রাচীনতম দল কংগ্রেসের ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ২০ শতাংশ। বাকিটা অন্যান্য দল। বিজেপির খরচকে প্রার্থী সংখ্যার সঙ্গে মেলালে মাথাপিছু কয়েক কোটি টাকা হচ্ছে। সেই কারণেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে বলতে হয়েছে, ভোটে লড়াই করার মতো অর্থ আমার নেই। আমার মতে, ভোটে অর্থশক্তির দাপটকে কেউ এভাবে বেআব্রু করেননি।
এখন প্রশ্ন হল, ভোটের খরচ বলতে কোন খরচকে ধরা হয়? টিএন শেষণ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর প্রার্থীর খরচখরচায় নজরদারিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেন। কমিশন থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৮-এর লোকসভা ভোটে গান্ধিনগরে লালকৃষ্ণ আদবানির বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রচার কভার করতে গিয়ে একদিন দেখতে পাই শেষণ ডায়ারিতে চায়ের খরচ লিখেছেন, ‘টি-রুপিজ টেন’। নিজের চালু করা নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তাঁর উত্তরসূরিরা এখন প্রার্থীর অফিসের আলপিন খরচও বেঁধে দিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সহ বড় রাজ্যগুলিতে কমিশন এবারের লোকসভা ভোটে ৯৫ লাখ টাকা খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ প্রার্থীর এর ধারেকাছে খরচের সামর্থ্য নেই। কিন্তু বাকিদের আবার খরচে বিধিনিষেধটাই যত সমস্যার, ভূতে টাকা জোগায় যাদের।
এই অনুচ্ছেদ যে প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গে আসি। ভোটে খরচ হওয়া বিপুল অর্থের ৩৫ শতাংশ ব্যয় হয় প্রচারে। ৪০ শতাংশ ভোটের অন্যান্য খরচ সামাল দিতে। বাকি ২৫ শতাংশ বা প্রায় ১৫ হাজার কোটি ভোটারদের বিলি করা হয়। মানে ঘুষ। তার পুরোটাই কালো টাকা। অর্থাৎ নির্বাচনই দুর্নীতির সবচেয়ে উর্বর ভূমি।
লক্ষণীয়, নির্বাচনি বিধিভঙ্গেও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য আছে। পশ্চিমবঙ্গ মারামারি, কাটাকাটি, ছাপ্পা ও ভুয়ো ভোটে পিএইচডি করেছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশে একটা সময় মাফিয়া, গ্যাংস্টাররাই শুধু নয়, স্বনামধন্য নেতাও সঙ্গে কয়েক ডজন বন্দুকধারী প্রাইভেট আর্মি নিয়ে প্রচার করতেন। খবরের কাগজে বন্দুকধারী পরিবৃত প্রার্থীর ছবি ছাপা হত। যাতে লোকে ভয়ে ভোট দেয়। সেই বিহার-ইউপি এখন আমূল বদলে গিয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণে, তামিলনাডু, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানার মতো রাজ্যে ভোটে এখনও টাকাই শেষকথা। বছর কয়েক আগে মাদুরাই শহরে ভোটের একটি অভিজ্ঞতা বলি। সন্ধ্যায় এক মার্কেটে হঠাৎ লোডশেডিং হলে কানে এল দোকানিরা পুলিশ পুলিশ করছে। আলো ফিরতে এক দোকানি জানালেন, ‘রাজ্য নির্বাচন দপ্তর থেকে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানো হয়েছে, লোডশেডিং হলে আগে পুলিশে খবর দিন।’ কারণ, ভোটের সময় এলাকা অন্ধকার করে বাইকবাহিনী এসে মুহূর্তে টাকা বিলি করে। পরে মুখে মুখে জানিয়ে দেওয়া হয় কোন দল কোন প্রার্থী টাকা দিয়েছে। অর্থ শক্তি যদিও ক্রমে সর্বভারতীয় রূপ নিয়েছে। কারণ, প্রার্থীর খরচের ঊর্ধ্বসীমা থাকলেও দলের নেই। আর শাসকদল হলে তো পোয়াবারো।
মোদি সরকার ভোট ঘোষণার আগের কয়েক মাস ধরে ‘বিকশিত ভারত’ নামে দেশব্যাপী প্রচার চালিয়েছে। রথ নামধারী হাজার হাজার গাড়ি দেশের কোনায় কোনায় ছুটেছে সরকারি প্রকল্পের প্রচার করতে। মোদির সাফল্য প্রচার মানে বিজেপির অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তন। এই সরকারি প্রচার যজ্ঞের খরচের অঙ্ক এখনও অজানা।
দু’দশক আগে মোদির পূর্বসূরি অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ প্রচারে খরচ হয়েছিল দেড়শো কোটি টাকা। আজকের অঙ্কে সেটা হাতের ময়লা। সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৮-’১৯ থেকে ২০২২-’২৩-এর মধ্যে ভারত সরকার প্রচার খাতে খরচ করে ৩০২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভোটের বছর অর্থাৎ ২০১৮-’১৯-এ খরচ করে ১১৭৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ভোট না থাকায় ২০২২-’২৩-এ খরচ কমে হয় ৪০৮ কোটি।
নরেন্দ্র মোদি তাঁর শাসনকালকে সংস্কারের দশকও বলে থাকেন। নির্বাচন কমিশন ভোটে অর্থশক্তিতে লাগাম দিতে সংস্কারের তিনটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এক, ভোটের ছয় মাস আগে সরকারের সাফল্য প্রচার বন্ধ। দুই, দলের খরচও প্রার্থীর খরচ হিসাবে গণ্য হবে। তিন, ভোটে দলগুলিরও খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হোক। মোদি সরকার উচ্চবাচ্য করেনি।
(লেখক সাংবাদিক)