- গৌতম হোড়
দিল্লির সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর সীমানা এক ঝলক দেখলে মনে হবে যুদ্ধক্ষেত্র বা কোনও শত্রু দেশের সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া, মাটি খুঁড়ে রাখা হয়েছে, বড় বড় সিমেন্টের ব্যারিকেড, তার সামনে মোটা মোটা পেরেক সিমেন্ট দিয়ে লাগানো। অনেক জায়গায় ব্যারিকেডের সামনে লোহার রডও লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাস্তার পাশে নয়ানজুলি কেটে রাখা হয়েছে। কিছু জায়গায় রাস্তারও একই হাল। প্রচুর সশস্ত্র পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী কাঁদানে গ্যাসের যন্ত্র ও বন্দুক নিয়ে প্রস্তুত। কোনও বেগরবাই দেখলেই তা ব্যবহার করা হবে। টিভি ও সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে দিল্লির সীমানার এই ছবি এবং পুরো ভারত দেখে ফেলেছে।
এই আয়োজন বিক্ষোভরত কৃষকদের দিল্লি প্রবেশ বন্ধ করার জন্য। ২০২১ সালে যে কৃষক বিক্ষোভ দিল্লির সীমানায় এসে আছড়ে পড়েছিল, তার জেরে কেন্দ্রীয় সরকারকে নতিস্বীকার করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির এতবড় পরাজয় কমই হয়েছে। এর আগে ভূমি অধিগ্রহণ আইন নিয়ে হয়েছিল। তারপর কৃষকদের বিক্ষোভের জেরে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হল। মোদি নিজে এবং বিজেপি তিল তিল করে প্রধানমন্ত্রীর একটা ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। সেটা হল, মোদি হলেন কঠোরতম প্রশাসক, যিনি একবার কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে পিছু হটেন না। কারণ, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অনেক চিন্তাভাবনা করে ও দেশের স্বার্থে। সেই মোদিকে যখন কৃষক বিক্ষোভের জেরে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হয়, তখন সেই ভাবমূর্তিতে তো একটা ধাক্কা লাগেই। কারণ, ততদিনে কৃষকরাও তাঁদের জোর দেখিয়ে দিতে পেরেছেন। দেখিয়ে দিতে পেরেছেন, তাঁদের ঐক্য। কৃষকদের ক্ষোভ ভোটে পড়বে সেটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই ঠিক সময়ে সরকার পিছিয়ে এসেছিল।
দিল্লির সিঙ্ঘু, টিকরি ও গাজিপুর সীমানায় সেবার দেখেছিলাম কৃষকদের একটা অসাধারণ বিক্ষোভ। ট্র্যাক্টরে খড় পেতে তাঁরা শুচ্ছেন। চারবেলা ঢালাও খাবার দেওয়া হচ্ছে লঙ্গর থেকে। ছোট ছোট মিছিল হচ্ছে। একটা বড় জায়গা ঢেকে সেখানে বড় সভা হচ্ছে। শুধু নেতারাই নন. সাধারণ কৃষকরাও নিজেদের কথা বলছেন। সেখানে একটা লাইব্রেরি ছিল। তাতে হিন্দিতে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত রাখা ছিল। খড় পেতে তার উপর চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছিল। সেখানে শুয়ে বসে বই পড়তে পারতেন যে কেউ।
এবারের আন্দোলন সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এবারের আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছে কৃষক আন্দোলন ২। সেখানে নেতারা বদলে গিয়েছে। মূল সংগঠন ভেঙে গিয়েছে। প্রধান দাবিরও কিছুটা বদল হয়েছে। গতবার এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল সংযুক্ত কিষান মোর্চা। আগেরবার নেতৃত্বে দেখা গিয়েছিল রাকেশ টিকাইট, বলবীর সিং রাজেওয়াল, দর্শন পাল, যোগেন্দ্র সিং উগ্রহান, গৌতম সিং চারুনি, যোগেন্দ্র যাদবদের। ছিলেন সিপিএমের কৃষকসভার নেতা হান্নান মোল্লা। ছিল পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানের কৃষক সংগঠনগুলি।
এবার মূল সংগঠন ভেঙে সংযুক্ত কৃষকসভা (অরাজনৈতিক) আন্দোলন করছে। এবারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগজিৎ সিং দাল্লেওয়াল, স্বর্ণ সিং পান্ধের, অভিমন্যু কোহার। প্রথম দুজন পঞ্জাব ও তৃতীয়জন হরিয়ানার নেতা। এবারও আন্দোলনটা শুরু হয়েছে পঞ্জাবে। কিন্তু ২০২১-এর তুলনায় এবার কম কৃষক সংগঠন যোগ দিয়েছে। জাঠ খাপ পঞ্চায়েতগুলি যোগ দেয়নি। ফলে গতবারের তুলনায় তাদের শক্তি কম। গতবার কৃষকদের প্রথম দাবি ছিল, তিনটি কৃষি আইন বদল করতে হবে। তারপরের দাবি ছিল ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যকে আইনি করতে হবে। অর্থাৎ, সরকার যে ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য ঘোষণা করবে, সেই দামে সবাইকে ফসল কিনতে হবে। এখন ফড়ে, কোম্পানি বা ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ মূল্যের কম দাম দিয়ে ফসল কেনে। তখন আর সেটা হবে না। কৃষকদের দাবি, স্বামীনাথন কমিশনের ফর্মুলা মেনে নিয়ে ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করতে হবে।
এখনও পর্যন্ত কৃষক আন্দোলন পঞ্জাবের সীমানা পেরোতে পারেনি। পঞ্জাব ও হরিয়ানায় সিন্ধু সীমানায় তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তাবাহিনী সেখানে সীমানা বন্ধ করে রেখেছে। সেই অবরোধ সরিয়ে কৃষকরা এগোতে চাইলে তাঁদের উপর কাঁদানে গ্যাসের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই প্রথমবার ড্রোন থেকে কাঁদানে গ্যাস ফেলার দৃশ্য দেখে ফেলেছে গোটা দেশ। ফলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, শক্তি কিঞ্চিৎ কম হলেও কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। তারা কৃষকদের কোনওভাবেই দিল্লিতে পৌঁছোতে দিতে চায় না। কারণ, দিল্লি পৌঁছালেই শুধু ভারতের নয়, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি সারাক্ষণ থাকে সেই আন্দোলনের উপরে। ফলে সরকারের উপরে চাপ অনেকটাই বেড়ে যায়। আর লোকসভা নির্বাচনের আগে কৃষকরা দিল্লিতে এসে বড় আন্দোলন করলে, মাসের পর মাস বিক্ষোভ দেখাতে থাকলে তার প্রভাব দেশের অন্য রাজ্যের কৃষকদের উপর পড়বে। তখন শুধু পঞ্জাব বা হরিয়ানা নয়, অন্যরাও যোগ দিতে পারে। লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই ঝুঁকি কে-ই বা নিতে চায়। সেজন্যই দিল্লি-প্রবেশ বন্ধ করার জন্য প্রকৃত অর্থেই যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখিয়েছে সরকার।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। গত কয়েক মাসে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কৃষকরা রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন। কিছুদিন আগেই ওই ট্র্যাক্টর চালিয়ে প্যারিসকে প্রায় অবরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন ফ্রান্সের কৃষকরা। তার আগে জার্মানিতে কৃষকরা বার্লিনে গিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। এছাড়াও ইতালি, স্পেন, লিথুয়ানিয়া, গ্রিস, রোমানিয়া, পোল্যান্ডেও কৃষকরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কোথাও দাবি মানা হয়েছে, কোথাও হয়নি। কিন্তু এমন যুদ্ধং দেহি মনোভাব দেখায়নি কোনও পক্ষই। কেন্দ্রীয় সরকার এবারও কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। তবে সেটা পঞ্জাবে গিয়ে। দিল্লিতে এখনও পর্যন্ত নেতাদের ডাকা হয়নি। কোনও সমাধানসূত্র পাওয়া গেলে অন্য কথা, না হলে দিল্লিতে কৃষক বা তাঁদের নেতাদের আসতে দিতে চায় না সরকার।
আসলে ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য আইনি হলে সারা ভারতের কৃষক লাভবান হবেন। সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন পঞ্জাবের কৃষকরা। কারণ, তাঁদের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি চাল ও গম কেনে সরকার। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট বলছে, ২০২১-’২২ সালে পঞ্জাবের কৃষকদের কাছ থেকে ৩৬ হাজার ৭০৮ কোটি টাকার ধান কিনেছে সরকার। পশ্চিমবঙ্গে কেনা হয়েছিল চার হাজার ৮০৮ কোটি টাকার। পঞ্জাব থেকে গম কেনা হয়েছে ১৯ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকার। হরিয়ানার কৃষকদের কাছ থেকে ১০ হাজার ৮৪০ কোটির ধান ও আট হাজার ২৫৬ কোটির গম কিনেছিল সরকার। সেজন্যই এই দুই রাজ্যের কৃষক ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্যকে আইনি করার দাবি নিয়ে এতটা চিন্তিত ও আন্দোলনে নামতে সবসময়ই তৈরি। তার জন্য তাঁরা জান লড়িয়ে দেন। তাঁদের আশঙ্কা, সরকার ক্রমশ খাদ্যশস্য কেনা কম করে দেবে। তখন বড় ব্যবসায়ী, সংস্থা বা ফড়েদের কাছে তাঁরা কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। বর্ধমানের এক কৃষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি তাঁর ফসল ন্যূনতম সংগ্রহ মুল্যের থেকে কুইন্টালে চার হাজার টাকা কম দাম দিয়ে ফড়ের কাছে বিক্রি করেছেন।
আর ঠিক যে কারণে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁদের দিল্লিতে আসতে দিতে চায় না, ঠিক সেই কারণেই কৃষকরা এখন আন্দোলনে নেমেছেন। ভোটের আগে তাঁরা জোরদার আন্দোলন করলে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি মেনে নেবে। কেন্দ্রীয় সরকার এখনও পর্যন্ত ছোট কয়েকটি দাবি মেনে নেবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এমএসপি-কে আইনি করা নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। কেন্দ্র যখন ৮০ কোটি মানুষকে প্রতি মাসে বিনা পয়সায় র্যাশন দিচ্ছে, তখন তাদের এই সংগ্রহ মূল্যকে আইনি করার ক্ষেত্রেই বা অসুবিধা কোথায়? কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ফলে সেইমতো সংগ্রহ মূল্য বাড়াতেই বা অসুবিধা কোথায়? কারণ, কৃষি নিয়ে এত কথা বলা হলেও কৃষকরা তো উপযুক্ত পরিমাণ টাকাটা পান না। পান দালাল-ফড়ে বা বড় ব্যবসায়ী বা সংস্থাগুলো। এখন বাসমতী চালের কেজি কমবেশি একশো টাকা। কৃষকরা কত পেয়েছেন? খুব সামান্য অর্থ। বাকিটা ব্যবসায়ীদের কামাল। অন্নদাতাদের নিয়ে এত কথা বলা হয়, তাঁদের ঘরে একটু লাভ পৌঁছে দিতে এতটা অনীহা কেন?
এখন এমন একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে, বিক্ষোভ মানেই খারাপ, আন্দোলন তো খুবই বাজে জিনিস। দাবি আদায়ের একমাত্র পথ হল আবেদন নিবেদন। সরকার মেনে না নিলে আর কিছু করা যাবে না। আবার একটু বিদেশের দিকে তাকাই। জার্মানিতে শুধু কৃষকরা নয়, ট্রেনচালক, বিমানবন্দরে লুফৎহানসার কর্মীরা, ট্রাকচালকরা, বাস ও ট্রামের সঙ্গে জড়িতরা ধর্মঘট ডেকেছেন। দবি একটাই, বেতন ও ভাতা বাড়াতে হবে। সরকার যতটা বাড়াতে চাইছে, ততটা তাঁদের পছন্দ হয়নি। তারপরেও তো গেল গেল রব উঠছে না সেখানে।
ভারতে আন্দোলনকারীরাও জঙ্গি মনোভাব নেয়। কৃষকরাও দিল্লিতে এসে সীমানা অচল করে দিতে চান। এমনও তো করা যেত, বড় বিক্ষোভের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রেখে দেওয়া থাকবে। সেখানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখানো যাবে। তাহলে অশান্তি ছাড়া, গুলি, কাঁদানে গ্যাস, লাঠি ছাড়া নিজেদের প্রতিবাদ জানানো সম্ভব হবে। খুবই কি অসম্ভব সেটা? নাকি জঙ্গি আন্দোলন ছাড়া সরকারও কথা শুনবে না, আন্দোলনকারীদের দাবিও পূর্ণ হবে না?
(লেখক সাংবাদিক)