- দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী
আবার একটা কৃষক আন্দোলন শুরু হয়েছে। ২০২০–’২১–এর সঙ্গে এই আন্দোলনের কিছুটা ফারাক আছে। তবে আগের বারের মতোই এ বারের আন্দোলনও সম্পন্ন চাষিদের আন্দোলন। কিন্তু আগেরবার এতে যুক্ত ছিলেন পঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের চাষিরা, আর এবার শুধুই পঞ্জাবের চাষিরা। আগের বারের মূল দাবি ছিল নরেন্দ্র মোদি সরকারের কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহার করা, এবং শেষপর্যন্ত শাসকদল এই চাপের সামনে ভেঙে পড়েছিল।
তখন কেন্দ্রের পিছিয়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ ছিল পঞ্জাবে বিধানসভা নির্বাচন। তবে পিছিয়ে গিয়েও পঞ্জাবে বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি বিজেপির, বরং ফায়দা তুলেছিল আপ, যারা আন্দোলন সমর্থন করেছিল। এবার মূল দাবি হল ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) বাড়ানো, এবং তার আইনি নিশ্চয়তা দেওয়া। দাবিগুলি আদৌ যুক্তিপূর্ণ কি না সেই প্রশ্নগুলো তো আছেই, আর যে প্রশ্নটা আছে তা হল ২০২০–’২১ থেকেই এমএসপি নিয়ে এত হইচই শুরু হল কেন?
আমি নিজে মনে করি পরিবর্তিত পৃথিবী ও পরিস্থিতিতে সরকার যে কৃষি আইনগুলো এনেছিল, সেগুলো যথেষ্ট কার্যকর ছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি মহাশয়ের কাছে ভোটই সব, এবং ভোটের জন্য তিনি তাঁর যে কোনও সংকল্প বিসর্জন দিতে পারেন। যাই হোক, যা বাতিল হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। বরং এবারের আন্দোলনের দিকে নজর কেন্দ্রীভূত করা যাক।
এখনকার বিক্ষোভ জগজিৎ সিং ধল্লেওয়াল ও সারওয়ান সিং পান্ডের নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত কিষান মোর্চা পরিচালনা করছে। আগের কৃষক আন্দোলনের সময় এই নেতাদের নাম বিশেষ শোনা যায়নি। আবার দর্শন পাল ও বলবীর সিং রাজেওয়ালের নেতৃত্বে দুটি দল ১৬ ফেব্রুয়ারি ভারত বনধের ডাক দিয়েছিল। বিকেইউ (উগ্রাহন) ১৫ ফেব্রুয়ারি হরিয়ানায় রাষ্ট্রীয় শক্তির অত্যধিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে রেল রোকোর জন্য আলাদা ডাক দিয়েছিল। এইসব নেতার নাম কেউ কখনও শোনেননি। হরিয়ানায় এই আন্দোলনের কোনও প্রভাব পড়েনি। ২০২০ সালে কৃষকদের আন্দোলনে যে ৩২টি সংগঠনের একটি সমষ্টির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অন্তত ৯০ শতাংশ এবার অনুপস্থিত। রাকেশ টিকাইট ও গুরনাম সিং চারুনির নেতৃত্বাধীন ইউনিয়নগুলি এর অংশ না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এঁরা অনেকেই বলছেন, এবারের আন্দোলনের মূল কারণ, কিছু নতুন এবং কম–খ্যাত লোকজন নিজেদের বিখ্যাত করে তুলতে চাইছেন।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা মানুষের থাকতেই পারে এবং তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আগের প্রতিবাদ আন্দোলন সুশীল সমাজের কর্মী, শিল্পী, পেশাজীবী এবং এমনকি অবসরপ্রাপ্ত বা চাকরিরত সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক ও ছাত্রদের একাংশের সমর্থন পেয়েছিল। আন্দোলনটি যে ধনী কৃষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, তার প্রমাণ আন্দোলনকারীদের চাষাবাদ করতে গ্রামে ফিরতে হয়নি, তাঁরা বহু মাস ধরে দিল্লিতে বসে ছিলেন। সাধারণ চাষিদের পক্ষে এই বিলাসিতা সম্ভব নয়। মাওবাদী সহ হিন্দুত্বের কট্টর–বিরোধীরা এই আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন। যে বামপন্থীরা একসময়ে চরণ সিংকে বলতেন কুলাকদের নেতা (তিনি হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ধনী চাষিদের নেতা ছিলেন), সেই বামেদের কুলাকদের আন্দোলনে যোগ দিতে অসুবিধা হয়নি। এর একটা কারণ ছিল মোদি–বিরোধিতা, এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল কৃষি সংস্কারে তাঁদের আপত্তি।
সরকারের বিরোধিতা করার অধিকার সকলেরই আছে। আর বামেরা তো কম্পিউটারাইজেশনেরও বিরোধিতা করেছিলেন, এবং এখন ল্যাপটপ নিয়ে ঘোরেন। ’৯১ থেকে সমস্ত অর্থনৈতিক সংস্কারেরও তাঁরা বিরোধিতা করে আসছেন, এবং পরে সেগুলোই অনুসরণও করেছেন। কাজেই কৃষি সংস্কারে তাঁদের বিরোধিতা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া সেসময় কৃষকদের মূল দাবিগুলি মেনে নিয়ে সরকারই সেই আন্দোলনের বৈধতা দিয়েছিল।
লক্ষণীয় ঘটনা হল, যে চাষিরা আন্দোলন করেছিলেন তাঁরা হয়তো দেশের মোট চাষির কুড়ি ভাগের এক ভাগ। দেশের বাকি চাষিরা এই আন্দোলনের সমর্থন বা বিরোধিতা কিছুই করেননি। আন্দোলনের দাবিতে তাঁদের সমর্থন ছিল কি না, তা জানারও তাই কোনও উপায় ছিল না। এবারের দাবিতে বরং চাষিদের সাধারণভাবে একটা নৈতিক সমর্থন থাকতেই পারে। কারণ এখন মূল দাবিটাই হল এমএসপি বাড়ানো। বেশি দাম পেতে কার না ভালো লাগে? তাই এই দাবিটির বিরোধিতা নিশ্চয়ই কোনও কৃষকই করবেন না।
এই চাষিরা যে দাবি করছেন সেই অনুযায়ী, অর্থাৎ স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এমএসপি দিতে হলে বছরে ১০ লক্ষ কোটি টাকার মতো লাগবে (যা কিনা পরিকাঠামো খাতে কেন্দ্রের এক বছরের ব্যয়)। আগের কংগ্রেস সরকার কমিটির ওই সুপারিশ গ্রহণ করেনি, বর্তমান সরকারও করেনি। এখন এমএসপি–র জন্য খরচ হয় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা।
সাধারণ জ্ঞান বলে, নিজেদের পণ্য চড়া দামে সরকারের কাছে বিক্রি করার জন্য জোরাজুরি করার চেয়ে ফসল বিমা করে নেওয়া অনেক বেশি অর্থনীতি–সম্মত। তার সুব্যবস্থার জন্য আন্দোলনের পরিবর্তে এঁরা চাইছেন করদাতাদের টাকায় এঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করা হোক। ঠিক যেমন পেট্রোলের উপর ভরতুকি বজায় রাখা হোক, এবং দরিদ্রতর মানুষ তাঁদের গাড়ি চড়ার খরচের একাংশ বহন করুন, এটাই ছিল বহুদিন ধরে বামপন্থী–দক্ষিণপন্থী সকলের সমর্থিত মধ্যবিত্তের দাবি। এবারের আন্দোলনে কৃষকদের আরও দাবি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা থেকে ভারতের সরে আসা (!!!), কৃষিঋণ মকুব করা, কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের পেনশন দেওয়া, ২০২০–’২১ বিক্ষোভের সময় কৃষকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার এবং ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি।
এবার দেখা যাক, এমএসপি কী কমে গিয়েছে বলে এত হইচই। সরকারি সূত্রে কিন্তু বলা হয়েছে, কৃষকেরা আগের দশকের তুলনায় গত ছয় বছরে সরকারি সংগ্রহ থেকে অনেক বেশি লাভ করেছেন। কারণ হিসাবে তাঁরা বলেছেন, মোদি প্রশাসন আগের মনমোহন সিং জমানার তুলনায় খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে ন্যূনতম সমর্থন মূল্য অনেক দ্রুত বাড়িয়েছে। ২০০৪–’০৫ থেকে ২০১৩–’১৪ পর্যন্ত সমস্ত ফসলের জন্য এমএসপি–তে গড় বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ৯%, কিন্তু খাদ্যশস্যের পাইকারি মূল্য সূচকের (ডব্লিউপিআই) বার্ষিক ৮% হারে বৃদ্ধির ফলে কৃষকের প্রকৃত প্রাপ্তি দশ বছর ধরে প্রায় একই জায়গায় ছিল। অন্যদিকে, ২০১৪–’১৫ থেকে ২০২০ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের জন্য গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল মাত্র ৪%, আর সমস্ত ফসলের জন্য এমএসপি বেড়েছে ৮%। সহজ অর্থ কৃষকের প্রকৃত প্রাপ্তি দ্রুত বেড়েছিল। এরপর কোভিড–১৯ ইত্যাদির কারণে সরকারের ব্যয়বৃদ্ধি ও বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি গল্পটাকে বিপথগামী করেছিল। তবে সবকিছুই ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে আসছে।
অর্থাৎ কৃষক আন্দোলনের মূল বিষয় সব সময়েই থাকছে দুটো : এক, রাজনৈতিক; আর দুই, করদাতাদের টাকায় যতটা বেশি সম্ভব বাড়তি সুযোগ আদায় করে নেওয়া। এই কাজটাই আগে মধ্যবিত্ত শ্রেণি করত, এখন সেই ভূত চেপেছে কৃষকদের ঘাড়ে। আর নয়াদিল্লির আশপাশের চাষিদের বাড়তি সুবিধা হল, তাঁরা সহজেই রাজধানী পৌঁছে যেতে পারেন। আর জাতীয় মিডিয়ার কাছে তো দিল্লিই ভারত, তাই দিল্লিতে আন্দোলন মানেই জাতীয় আন্দোলন, জাতীয় প্রচার ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব…।
(লেখক সাংবাদিক)