- শুভময় সরকার
ছোট্ট একটা ঘটনার কথা মনে পড়ল এই বসন্তবেলায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উথালপাথাল দিনে আবিরে রঙিন হয়ে আমরা ক’জন প্রিয় এক স্যরের কোয়ার্টারে গেলাম আবির দিয়ে প্রণাম করতে। তো স্যর হাসিমুখে দরজা খুলে বললেন, আগে বলো, দোল খেলে এলে নাকি হোলি? আমরা কিঞ্চিৎ আপাত স্মার্টনেসে উত্তর দিয়েছিলাম, রং খেলে স্যর…! স্যরও মুচকি হেসে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন।
সেদিনকার মতো সামলে দেওয়া গেলেও আমাদের নিজেদের কাছেই কিন্তু ‘দোল’ আর ‘হোলি’র আপাত ঘেঁটে যাওয়ার মাঝেই কোথাও এক বিরোধাভাসের ইঙ্গিত ছিল। প্রতিবারই সেই একই সংশয় ঘুরেফিরে মস্তিষ্কে কড়া নাড়ত, ‘দোল’ না ‘হোলি’…!
সত্যিই কি দোল-উৎসব আর হোলি এক এবং অভিন্ন? নাকি কোথাও এক ভেদরেখা আছে। কিঞ্চিৎ পুরাণচর্চায় আসা যাক বরং…! ‘হোলি’ নিয়ে যে পৌরাণিক কাহিনী অর্থাৎ হিরণ্যকশিপুর সেই কাহিনী আমাদের জানা। ভক্ত প্রহ্লাদের অসুর বংশে জন্মগ্রহণ সত্ত্বেও ধার্মিকতা এবং তাকে হত্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা, হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ এবং বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদের অগ্নিকুণ্ড থেকে অক্ষত বেরিয়ে আসা এবং হোলিকার মৃত্যু। ‘হোলি’ কথাটির পৌরাণিক এই পটভূমির এক সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বাংলায় আমাদের দোলযাত্রাই পশ্চিম ও মধ্য ভারতের হোলি। রং উৎসবের আগের দিন হোলিকা দহন, অর্থাৎ অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আমাদের বাংলায় একে নেড়া পোড়াও বলে। তবে এই বাংলায় ‘দোল’-এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মিথ। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রঙের উৎসব চালু করেছিলেন, যদিও তার সময়কাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে রঙের এই উৎসবের সঙ্গে যাঁর নাম অনিবার্যভাবে চলে আসে তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ। এই পাতাঝরার দিনেই তো রঙের উৎসবকে তিনি বসন্ত উৎসবে পরিণত করলেন, যদিও ছোট পুত্র শমীন্দ্রনাথের হাত ধরে শুরু বসন্ত উৎসবের।
বঙ্গজীবনের নিজস্ব চিহ্নগুলো কবে কখন যেন অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে, যেভাবে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে একটা আত্মবিস্মৃত জাতি। ‘হোলি’র সঙ্গে ‘দোল’-এর কোনও বিরোধ নেই কিন্তু ‘দোল’ শব্দটির সঙ্গে বাঙালি-অনুভূতির যে সূক্ষ্ম যোগ, হোলির উচ্চকিত স্বরে তা বড়ই অনাদরের এক শব্দ হয়ে উঠছে। শান্তিনিকেতনী ঘরানায় এখন ‘বসন্ত উৎসব’ কিংবা ‘ঋতুরঙ্গ’ উৎসব আমার শহর সহ অনেক জায়গাতেই হচ্ছে বটে, তবে ‘হোলি হ্যায়’-এর উচ্চকিত স্বরে সে সব নেহাতই কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এক সংস্কৃতি হয়েই রয়ে গেল, কখনোই আপামর বঙ্গজীবনকে ছুঁয়ে ফেলতে পারেনি। আমাদের এই পুণ্যতীর্থে দেওয়া আর নেওয়ার মাঝেই এক বহুস্বরের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। আমরা আনত হই সেই নানা রঙের সংস্কৃতির কাছে কিন্তু প্রতিটি অঞ্চল তার নিজস্বতা নিয়েই রয়ে যাক সেই বহুস্বরে, নিজের অস্তিত্ব এবং চিহ্ন বিসর্জন দিয়ে নয়। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস-জীবনে স্যরের সেই কৌতুকমাখানো প্রশ্নের উত্তর হয়তো-বা আজও খুঁজে চলেছি। একসময় মজা করে ‘দোল’ আর ‘হোলি’ মিশিয়ে বলতাম ‘দোলি’, এখন সেই মাঝামাঝি স্পেসটাও সম্ভবত হারিয়ে গিয়েছে। এই বাংলায় এখন ‘হোলি’র কাছে ‘দোল’ দশ গোল খেয়ে বসে আছে, আমার শহরেও। যাই হোক, সত্যকে মেনে নিয়েই আসুন, আমরা বরং মেতে উঠি রঙের উৎসবে।
(লেখক শিলিগুড়ির বাসিন্দা)