- রূপায়ণ ভট্টাচার্য
আপনারা ক’টা আসনে জিততে পারেন? দু’দিন আগের সকালে একদা উত্তরবঙ্গের অঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী বলে পরিচিত অশোক ভট্টাচার্যকে প্রশ্নটা করেছিলাম। স্পষ্ট উত্তর মেলে না। পুরোনো স্কুলের রাজনীতিবিদদের মতো অশোক ভদ্রলোকসুলভ এড়িয়ে যান। সিপিএমসুলভ ধাঁধাও রেখে দেন। তবে একটা কথা বলার সময় অকপট তিনি, ‘আমাদের কর্মীরা একটা অস্থিরতায় ভুগছে। এতদিন পর্যন্ত প্রার্থীতালিকা ঘোষণা না হওয়ার জন্য।’
অস্থিরতা। আবার একটা নতুনতম শব্দ শোনা গেল বঙ্গজ ভোটনাট্যে। সৌজন্য সিপিএম। এককালের দুর্বিনীত ৩৪ বছরের শাসকদের এমন দুর্বিপাক, তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে একসময়ের ঘোর শত্রু কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের দিকে। কংগ্রেস কী করে দেখে তার পর তাদের সিদ্ধান্ত। অশোকের ব্যবহৃত শব্দ আসলে ‘অস্থিরতা’ নয়, হওয়া উচিত ছিল ‘বিভ্রান্তি’।
এই কং-বাম জোট নিয়েই আমরা আরও একটা নতুন শব্দ শুনেছি। দর্জির সেলাই। সিপিএমের সেলিম রসিক মানুষ। তিনি রসিকতা করতে গিয়ে সহজ সত্যি কথাটা বলে দিয়েছেন প্রেস মিটে। ‘পুজো বা ইদের আগে দর্জিদের দোকানে জামা দিলে তাঁরা কী বলেন, বলেন পুজোর আগে পেয়ে যাবেন। বা ইদের আগে পেয়ে যাবেন। আমরা বলছি, ভোটের আগে বাম-কংগ্রেস জোটের সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সেলিমকে পালটা প্রশ্ন করা যেত, পুজোর সময় তাড়াহুড়ো করে জামা বানাতে গিয়ে অধিকাংশ সময় মাপের ভুলে ছোট-বড় হয়ে যেত জামা। তাছাড়া ব্র্যান্ড এবং মলের যুগে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী আর দর্জির দোকানের দিকে ঘেঁষেন না। রেডিমেডেই আস্থা। দর্জির দোকানগুলো ধুঁকছে। সেলাই মেশিনের আওয়াজও প্রায় স্তব্ধ।
দর্জির সেলাইয়ের দিকে তাকিয়েও মালদা-মুর্শিদাবাদের দুটো আসনের বেশি ভাবতে পারছেন না বামেরা। এবং কিছুটা ক্ষীণ দক্ষিণ মালদা। তা হলে কি ধরে নেব, এখন কংগ্রেসের জয়েই সিপিএমের সুখ, কংগ্রেসের দুঃখেই সিপিএমের দুঃখ? সেই জোড়া বলদের যুগ থেকে গাই বাছুরের সময় থেকে কংগ্রেস সব সময় কাঁটা ও অভিশাপ কুড়িয়েছে বামেদের কাছে। এখন কংগ্রেসের জন্য অধীর আগ্রহে সিপিএমের ‘দর্জি’ হয়ে বসে থাকা দেখে স্বর্গ থেকে শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, সৈফুদ্দিন চৌধুরী, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়রা সকৌতুক হাসতে পারেন। যাঁরা অতীতে কংগ্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার তত্ত্ব বলে সিপিএমে বড় বেইজ্জত হয়েছিলেন।
সিপিএমের সেই ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান তো এখনও লোকে ভোলেনি। ‘দিল্লি থেকে এল গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই’। কিংবা কংগ্রেস হাত প্রতীক নেওয়ার সময়, ‘ঝোঁকের মাথায় নিলি হাত/ভোটে হবি কুপোকাত’। অধীর চৌধুরীও নিশ্চয়ই ওই স্লোগান একদা দেওয়ালে লিখেছেন, ‘চিনের চিহ্ন কাস্তে হাতুড়ি, পাকিস্তানের তারা/ এখনও কি বলতে হবে দেশের শত্রু কারা?’ অথবা ‘তোমার হাতে শাসনকাঠি/তোমার ক্যাডার তুমি নাচাও/নিজের ছেলে শিল্পপতি/তখন বলছ শিল্প বাঁচাও।’
এই একটা কারণও সিপিএমের সমর্থকদের অস্থিরতার পিছনে কাজ করছে। অস্থিরতার মানে এখানে বিভ্রান্তিও। নির্বাচনের মুখে বাংলায় অনেক তন্ত্র শোনা যাচ্ছে গণতন্ত্রের বদলে। গণতন্ত্রের জয় হোক আর বলে না কেউ। জয়ধ্বনিতে ওঠে কালীঘাটের পরিবারতন্ত্র, কাঁথির পরিবারতন্ত্র, দলবদলিয়াতন্ত্র, কুবাক্যতন্ত্র, মস্তানতন্ত্র, সিন্ডিকেটতন্ত্র, এজেন্সিতন্ত্র। এর সঙ্গে যোগ করা যায় দর্জিতন্ত্র, অস্থিরতাতন্ত্র, বিভ্রান্তিতন্ত্র। শেষ তিনটে শুধু সিপিএমকে ভেবে। এই যে ক’দিন আগে ব্রিগেডে মীনাক্ষী, সৃজনের দল লক্ষ মানুষ এনে সাড়া ফেলে দিলেন, তার রেশ এতটুকুও নেই কেন? এত দ্রুত হারিয়ে গেল সেসব উচ্ছ্বাস? অস্থিরতা ও বিভ্রান্তির জন্যই নয় কি?
বামেদের যে দুই প্রতিপক্ষ গুন্ডাতন্ত্রের প্রতিনিধি হয়ে রাস্তায় হাতাহাতি করলেন, তারও সুবিধে নিতে পারছে না সিপিএম। বাম আমলের শেষদিকের গুন্ডাতন্ত্রের দায় এতদিন পরেও বইতে হচ্ছে মীনাক্ষী-সৃজনদের। উদয়ন গুহ-নিশীথ প্রামাণিকদের উত্তরসূরিদেরও সেই দায় একদিন বইতেই হবে, নিশ্চিত থাকুন। দিদি ও মোদির নামে, মা-বোন ও রামের নামে কতদিন ভোট টানা যাবে আর?
দুই দলের দুই মন্ত্রী নিশীথ এবং উদয়ন দেখালেন, এখনকার সৌজন্যহীন রাজনীতি মানে গুন্ডামিরাত্রির উদয়। তৃণমূল বা বিজেপির বড় নেতাদের কাউকে দিনহাটার লজ্জাকর ঘটনার কঠোর নিন্দা করতে দেখলাম না। কেউই বললেন না, এ লজ্জা রাখব কোথায়? সবাই মূক ও বধির যেন। বাংলার রাজনীতি কোন রসাতলে নেমেছে, দিনহাটা তার সাক্ষী রইল। নিশীথের যা পুরোনো ইতিহাস, তাতে যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী হয়ে এতদিন চালালেন, তা অবিশ্বাস্য। উদয়নের ইতিহাসও ওই রকম ‘রোমাঞ্চকর’। দিনহাটার বীরদের ‘বীরগাথা’ শুনতে শুনতে তাঁর কিংবদন্তি বাবার আত্মজীবনীর কিছু লাইন মনে পড়বে।
‘আমার জীবন, আমার রাজনীতি’ বইয়ে কমল গুহ ১৯৫২ সালের ভোটের কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, ‘ভোট তো হল, ৪-৫ হাজার টাকার ঋণ মাথায় চেপে বসল। আমার আংটি, সোনার বোতাম, হাতের ঘড়ি, বেলার কিছু সোনার চুড়ি, জমির কয়েক মন ধান বিক্রি করে পরিস্থিতির সামাল দিলাম। সামনে কোনও কর্মসূচি নেই। রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হল। কিছুদিন পাটের ব্যবসা করলাম। ব্যবসায় লোকসান দিয়ে পাটের ব্যবসা ছাড়লাম।’
এখন কি কোনও নেতাকে ভোটের পরে ঋণে ডুবে যেতে হয়?
দুর্বাক্যের রাজনীতির কুচকাওয়াজ ছেড়ে উদয়ন ও নিশীথের উচিত কমলবাবুর আত্মজীবনী একদিন অন্তত পড়া। বামফ্রন্টের জাঁদরেল চেয়ারম্যান প্রমোদ দাশগুপ্তের কথা উপেক্ষা করে, কীভাবে রাজ্যের কৃষকদের কয়েক কোটি টাকার ঋণ মকুব করেছিলেন কমলবাবু। অফিসারদের আগেই ঋণের নথি তৈরি করতে বলায় প্রমোদবাবু বলেছিলেন, কমলবাবুর কি ব্যক্তিগত সম্পত্তি? আলোচনা না করে মতামত না নিয়ে যা খুশি তাই সিদ্ধান্ত নেবেন? কোনও কথা না বলে কমলবাবু প্রস্তাব মন্ত্রীসভায় পেশ করেছিলেন। তা অনুমোদন পেয়েছিল।
কলকাতায় উত্তরবঙ্গের মানুষদের থাকার জন্য কোচবিহার ভবন হয়েছিল সবার আগে। কোচবিহারের সিপিএমের চার বিধায়ক তাদের কোটার টাকা দেননি। বামফ্রন্টের সভায় জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিনয় চৌধুরী, সরোজ মুখোপাধ্যায়দের প্রশ্ন ছিল, একবার কোচবিহার ভবন হলে অন্য জেলাগুলোও এক দাবি তুলবে। তখন সামলানো যাবে না। প্রমোদবাবুকে কমলবাবু বলেছিলেন, ‘সরকার তো আমাদের জমি দিচ্ছে। টাকা দিচ্ছে না। টাকা আমরা তুলব। অন্য জেলাও এই ভাবে করুক না।’ কোচবিহারে মহিলা কলেজ, ক্যানসার সেন্টার, তোর্ষা সেতু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কমলবাবুই। গনি খান চৌধুরী এর চেয়ে অনেক কম বিপ্লব করেও মালদায় মিথ। কমলকে কি সেই প্রাপ্য দিয়েছে তাঁর সাধের কোচবিহার জেলা?
একবার তো জ্যোতিবাবুর সরকার পাটের সর্বোচ্চ মূল্য কুইন্টাল প্রতি ৪৯২ টাকা বেঁধে দেওয়ার কথা ঘোষণা করল। মহাকরণে নিজের চেম্বারে বসে কৃষিমন্ত্রী কমলবাবু প্রেস মিটে বললেন, ‘এই কৃষকমারা সিদ্ধান্ত বন্ধ করে দেব। সব রকমের অবস্থার মুখোমুখি হতে আমরা প্রস্তুত।’ জ্যোতিবাবু বললেন, ‘কমলবাবু পাটের কিছুই বোঝেন না’। সিটু নেতা মনোরঞ্জন রায় সরাসরি মন্তব্য করলেন, কমলবাবু জমিদারদের দালাল। বরুণ সেনগুপ্ত সেবার লিখলেন, ‘বিলাইতি ব্যারিস্টার বনাম দিনহাটার কৃষককর্মী কমল গুহ।’
নিজে দু’হাজার গীতাঞ্জলি কিনে দিনহাটার মানুষের মধ্যে বিলি করেছিলেন কমলবাবু। ৯০ দশকের শুরুতে দিনহাটায় দিনে ১০ থেকে ১২টা ডাকাতি হত। একবার মাসে ৭০০-র মতো ডাকাতি হয় দিনহাটা শহর ও শহরতলিতে। সেসবও বন্ধ হয়েছিল কমল-উদ্যোগে। সেই দিনহাটাকে আবার চল্লিশ বছর পিছনে নিয়ে ফেললেন কমলের পুত্র এবং উত্তরসূরি নেতারা। নিশীথ আবার এককালে তৃণমূলের নম্বর টু’র ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
আবার লিখি, উদয়ন বা নিশীথের এতদিনের এমন কোনও কাজ নেই, ইতিহাস তাঁদের মন্ত্রিত্ব মনে রাখবে। সাইয়ের খেলার স্টেডিয়াম নিয়ে নিশীথের উদ্যোগ একেবারে লোককে বোকা বানানোর খেলা, উত্তরবঙ্গ নিয়ে উদয়নেরও সুদূরপ্রসারী চিন্তার কাজ নেই। সিপিএমের দর্জিতন্ত্রের পাশাপাশি উদয়ন-নিশীথের প্রহারতন্ত্রও সোশ্যাল মিডিয়ায় খোশখোরাক হতে পারে।