- সানি সরকার
ভোট এলেই গোপালের ঠাকুমার কথা মনে হয়। সরকারি খাতায় তাঁর কী নাম ছিল, প্রতিবেশীরা কেউ জানেন না। জানার চেষ্টাও কেউ করেননি কোনওদিন। ছেলে-বুড়ো, সকলেরই তিনি গোপালের ঠাকুমা।
নির্বাচন এলে যেমন সেই ঠাকুমার কথা মনে পড়ে, তেমনভাবে সামনে চলে আসে ১৯৯৪ সালে শিলিগুড়ি পুর নির্বাচনের কথা। সেবার ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটগ্রহণ চলছিল মাইকেল স্কুলে। স্কুলের মাঠে ভিড় বাম, কংগ্রেস ও এসইউসিআই কর্মীদের। সকলে মিলেমিশে। সেসময় এমন রাজনৈতিক হানাহানি, কুকথার ফুলঝুরি শোনা যেত না। ভোটে প্রয়োজন হত না কেন্দ্রীয় বাহিনীর।
সে যাই হোক, ভোট দিয়ে মাঠ বরাবর বাড়ির পথ ধরেছেন গোপালের ঠাকুমা। কংগ্রেসের এক কর্মী কিছুটা উৎসাহের সঙ্গে তাঁর উদ্দেশে হাত উঁচু করে বললেন, ‘ঠাকুমা ঠিক জায়গায় দিয়েছ তো?’ অর্থাৎ হাত উঁচিয়ে ‘হাত’-এ ভোট দিয়েছেন কি না জানতে চাওয়া। ঠাকুমার উত্তর ছিল, ‘তর চিন্তা নাই, ক্যাইস্তাতেই দিছি।’ এই উত্তর শোনার পর ওই কংগ্রেস কর্মীর মুখের হাসি মুহূর্তে উধাও। পাশে দাঁড়ানো কংগ্রেস প্রার্থী বলে উঠলেন, ‘কী রে, কিছুই তো করতে পারলি না। সমস্তটা জলে গেল।’
এখন গোপালের ঠাকুমাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁরা না থাকায় সমস্ত খরচ জলেও যায় না। নেতাদের মতো ভোটারদেরও এখন খনে খনে রং বদলায়। কাগজের রং দেখে তাঁরা মত বদলান। তাই ভোট এলে টাকার পাখা গজায়। কিছুদিন আগে জলপাইগুড়ির এক পঞ্চায়েত সদস্যকে কেনার জন্য তাঁর বাড়িতে পাঁচশো টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। যা নিয়ে ওই পঞ্চায়েত সদস্য থানা-পুলিশের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
কিন্তু বন্ধ হয়েছে কি টাকার খেলা? একদম নয়। দেশের নির্বাচনের নানা দিক নিয়ে গবেষণা করে থাকে সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ (সিএমএস)। তাদের তথ্য অনুসারে, এবারের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে সব থেকে ব্যয়বহুল। সব মিলিয়ে ৫৪৩টি কেন্দ্রে খরচ হবে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা! অর্থাৎ প্রতি লোকসভা কেন্দ্রের জন্য খরচ ৯০ লক্ষের কাছাকাছি এবং ভোটার পিছু প্রায় ১,২০০ টাকা। ২০১৯-এর নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ৪৫-৪৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪-তে খরচের পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে খরচের অঙ্ক।
৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নির্বাচন কমিশনের খরচ ১৫-২০ শতাংশ। বাকি টাকাটা খরচ করে প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলি। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোটে প্রার্থীরা খরচ করতে পারতেন ২৫ হাজার টাকা। এবার প্রত্যেক প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন খরচের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছে ৯৫ লক্ষ টাকা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির খরচে কোনও বিধিনিষেধ নেই। ফলে নির্বাচনি খরচে লাগাম নেই দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলির।
ভোট, জনপ্রতিনিধি, তাঁদের নানাবিধ দিক নিয়ে সমীক্ষা করে থাকে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রাইট (এডিআর)। ওই সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-এর নির্বাচনের পর হাজার হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র চারজন হলফনামা দিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁরা কমিশনের বেঁধে দেওয়া ঊর্ধ্বসীমা অতিক্রম করেছেন। তাহলে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হল কীভাবে? যাঁরা লোকসভায় পা রাখতে পেরেছেন বা পারেননি, সকলে এ ব্যাপারে চুপ। অর্থাৎ কালো টাকা যে দেদার খরচ হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
অনেক ভোটার প্রশ্ন তুলতে পারেন, ‘১,২০০ টাকা তো চোখে দেখলাম না?’ আসলে সবাইকে দেখানো হয় না। টাকার রং চেনানো হয় তাঁদেরই, যাঁদের প্রলুব্ধ করা সম্ভব। এ কারণে টাকা বিলির সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। একদিন পর দ্বিতীয় দফায় ভোট। এখন পাহাড় থেকে সমতল, সর্বত্র চলছে কাগজের রং চেনানো। বাকি দফাগুলিতেও এই প্রবণতা থাকবে। যে রংয়ের দর বেশি, সেদিকে ঝুঁকবেন ভোটারদের একাংশ। ফলে ‘মানুষের রায়’ নিয়ে সংশয় থেকে যাবে। এই সংশয়, সন্দেহ থেকে যায় ভোটাররা এখন উপভোক্তা বা বেনেফিশিয়ারিতে পরিণত হয়ে উঠেছেন বলে।
একারণে নারায়ণ ভাণ্ডার কেন চালু হবে না, প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় অনেককে। অর্থাৎ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যদি মহিলাদের জন্য থাকতে পারে, তবে পুরুষদের জন্য কেন নারায়ণ জাতীয় কিছু থাকবে না? তবে এখন নাকি শুধু জনদরদি প্রকল্পে কাজ হচ্ছে না। এক রাজনৈতিক নেতার কথায়, ভোটাররা এখন নগদে ভরসা রাখছেন। তাই রাত বাড়লে পাড়া, মহল্লায় নেতাদের ভিড় বাড়ছে। ফলে গণতন্ত্রের উৎসব নিয়ে গর্বটা ক্রমশ ফিকে হচ্ছে। ফলে এখন আর টাকা মাটি নয়। টাকাতেই ভোট।