- কল্যাণময় দাস
১৯৫৪ সনের ১২ এপ্রিলে মানুষটা জন্মেছিলেন আর খুন হলেন ২ জানুয়ারি ১৯৮৯। নাটক করার জন্য। পূর্ণেন্দু পত্রী তাৎক্ষণিক আঘাতে লিখলেন ‘এই মৃত্যুশোক কাঁধ থেকে নামানো যাবে না কোনোদিন।/আর বর্বরতা কী নির্বোধ।/যেন মৃত্যু হলেই মুছে যায় প্রতিজ্ঞার প্রাণ।/আক্রমণ কোন নতুন শব্দ নয়।/হিংসা কোন নতুন শব্দ নয়।/নতুন শব্দ – সফদার হাসমি’। আজ থেকে চৌত্রিশ বছর আগে যে মানুষটা দেশকে নতুন করে আবার ‘হাল্লা বোল’ বলতে শিখিয়েছিলেন সেই মানুষটাকে খুন হতে হয়েছিল দিনের আলোয় প্রকাশ্য রাজপথে। কারণ? একটা সরকারের বিশেষ বিশেষ কিছু অবিবেচনার প্রতিবাদ ছিল তাঁর নাট্যে, পথনাট্যে।
তথাকথিত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নাট্যমঞ্চ তাঁর অভিনয়ের এলাকা ছিল না। এমনিতে নাট্য আসলে সংখ্যালঘু মানুষের শিল্প, তার ওপর টাকা খরচ করে বিনোদনের জন্য এই দেশের বাকি মানুষগুলো কী করে প্রেক্ষাগৃহে যাবেন? এইরকম বিশেষ চিন্তা থেকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পথ আর প্রশ্ন তোলার নাট্য। নাট্যের অভিনেতাদের উত্থিত সংলাপ যেন দর্শক শ্রোতাদের মর্মে গিয়ে আঘাত করে এবং একটা জটিল জরদ্গব রাষ্ট্র–ব্যবস্থার প্রতি নীরব না থেকে মানুষ যেন গর্জে ওঠে, অন্তত প্রতিবাদ করে। এই ছিল মানুষটার দর্শন। কিন্তু কোনও শাসনব্যবস্থাতেই প্রতিবাদীদের কোনও সম্মানের বেদি স্থিরিকৃত নেই, যা আছে তা শুধুই মার, মার এবং মেরে ফেল। ফলে সফদারকেও মরতে হয়েছিল। রাজনীতির সড়কে ‘হাল্লা বোল’ নাট্য প্রযোজনার সময় উগ্র, অধৈর্য, উন্মার্গগামী একদল ভাড়াটে গুন্ডার সমবেত আক্রমণে।
শ্রমজীবী মানুষের কথা, রাজনৈতিক শোষণের কথা, বঞ্চনার কথা সফদার বলে গিয়েছেন তাঁর প্রায় ২৫টি পথনাটকে, প্রায় চার হাজার শো হয়েছে গ্রামে-গঞ্জে-হাটে-মাঠে-ময়দানে-কারখানার গেটে-মহল্লায়-মহল্লায়। আর সেইসব নাট্য শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় না পাবার শক্তি জোগাচ্ছিল মেহনতি মানুষের মধ্যে। কিন্তু নয়াদিল্লির শাহিবাবাদের ঝন্ডপুর অঞ্চলের পথনাটক নিয়ে নেমেছিলেন তিনি, তাঁর স্ত্রী মলয়শ্রী হাসমি এবং তাঁর দল জননাট্য মঞ্চ। নাট্যকে বন্ধ করতে নির্বিচারে লাঠিচার্জ তো করেই উপরন্তু গুলি চালানো হয়। এবং সবথেকে শক্তিসঞ্চয়ী কথা যে, ঘটনার দু’দিন পরে একই জায়গায় তাঁর স্ত্রী মলয়শ্রী এবং জননাট্য মঞ্চের সদস্যরা একই নাট্য পথস্থ করেন ভয়ডরহীনভাবে। বরং সেই এলাকায় মৃত্যুর শোক নয়, ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠেছিলেন তাঁরা।
কিন্তু কথা হল, আজকের প্রজন্মের নাট্যশিল্পী, নাট্যব্যক্তিত্ব, যাঁরা প্রগতিশীল তকমা লাগিয়ে চলাফেরা করেন, যাঁরা মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁরাই বা কতটা হাসমির আত্মত্যাগকে জনগণের মনে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তা জানতে খুব মন চায় আমার। শহিদ সফদারের স্মৃতি রোমন্থন আজকের মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। অন্তত সেই মানুষগুলির কথা ভেবে যাঁদের কাছে বর্ষবরণ শুধুমাত্র আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার নয়। যাঁরা সেই দিনটিতেও জীবনের সেই চরম সত্যটা ভুলে যান না যে, সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ বর্ষবরণের রাতে ঘুমোতে যাবেন একদম নির্জলা উপোস করে, ভুখা পেটে।
(লেখক কোচবিহারের নাট্যশিল্পী)