Wednesday, May 1, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়আচার্য ধনকর বনাম আচার্য বোস

আচার্য ধনকর বনাম আচার্য বোস

চালিয়ে খেলে জগদীপ ধনকর উপরাষ্ট্রপতি। আনন্দ বোসও শিক্ষায় বিতর্কে জড়াচ্ছেন রাজ্যের সঙ্গে। তাঁর লক্ষ্য কী?

  • দেবদূত ঘোষঠাকুর

বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপরে কর্তৃত্ব আসলে কার তা নিয়ে রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই পশ্চিমবঙ্গে নতুন কোনও কথা নয়। তবে কোন সময়ে তা সব থেকে তীব্রতর অবস্থায় ছিল তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বছর তিনেক আগে লিখেছিলাম, তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকরের আমলে এই বিরোধ সব অতীত ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে।

সেসময় এই মূল্যায়নে আমাকে যাঁরা তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন, শিক্ষা দপ্তরের অন্দরের খবর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা সেই পূর্বতন আমলাদের পর্যবেক্ষণ, ওই দড়ি টানাটানির খেলায় ইতিমধ্যেই ধনকরকে ছাড়িয়ে চলে গিয়েছেন বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। কীভাবে? শিক্ষাবিদরা বলছেন,  হিসেব একেবারে পরিষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে কর্তৃত্ব ফলানোর লড়াইয়ের জেরে গত এক বছর ধরে রাজ্যের কোনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই স্থায়ী উপাচার্য নেই।

অস্থায়ী উপাচার্যদের কেউ কেউ এক বছরের বেশি সময় ধরে রয়ে গিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী অস্থায়ী উপাচার্য ছয় মাসের বেশি সময় থাকতে পারেন না। ওই ছয় মাসের‌ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে ফেলতে হয়। কিন্তু স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের চাবিকাঠি এখন সুপ্রিম কোর্টের কাছে। কবে যে চাবি দিয়ে এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষার ‘অন্ধ কুঠুরি’র দরজা খোলা হবে তা কেউ জানেন না।

পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনা নতুন নয়। সেই ১৯৬৭ সাল থেকে বিভিন্ন রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সংঘাত লেগেছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী কোনও দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকলেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাত হবে এটাই এখন নিয়ম। তবে ১৯৭৭  সালে বামফ্রন্ট সরকার আসার আগে ‘আচার্য’ রাজ্যপালের সঙ্গে কখনও শাসকদলের বিরোধ হয়নি। পুরোটাই সীমাবদ্ধ ছিল সরকার তৈরি আর সরকার ভাঙার মধ্যে।‌

২০১১ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে রাজ্যপাল হিসেবে রাজ্য পেয়েছে এমকে নারায়ণন, কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, জগদীপ ধনকর এবং বোসকে। চারজনই সরকারের সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে আচার্য রাজ্যপালের সঙ্গে সরকারের বিরোধ তেমন হয়নি। যেটা শুরু হল ধনকরের আমলে। আর তার চূড়ান্ত আকার নিল আচার্য বোসের জমানায়।

ধনকরের সময়কাল আর বোসের সময়কালের মধ্যে একটা মূল পার্থক্য হল দুজনের শুরুটা। ধনকর আসার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে সংঘাতের রাস্তা বেছে নেয় তৃণমূল সরকার। ধনকরও কম যান না। মানুষের একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, প্রতিদিন রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীদের সমালোচনা না করলে বুঝি নতুন রাজ্যপালের ভাত হজম হয় না।

রাজ্য সরকারও কম যায় না।  রাজ্যপাল কোনও নির্দেশ দিলে, বৈঠক করতে চাইলে সেখানে হামেশাই সরকারি অফিসার, মন্ত্রী, এমনকি উপাচার্যরাও যেতেন না।  দল হিসেবে তৃণমূলও সমানে রাজ্যপালের সমালোচনা করতে শুরু করে। দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়।  অতীতে কোনও রাজ্যপাল  কোনও মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্য সরকারের সমালোচনায় এমন আদাজল খেয়ে লাগেননি। আবার  অতীতে কোনও রাজ্য সরকার আর শাসকদলও রাজ্যপালের সমালোচনায় এত সময় এবং এত শব্দ নষ্ট করেনি।

অন্যদিকে, বোসের আবির্ভাব হয়েছিল লাল কার্পেট পেতে। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অপ্লুত নতুন রাজ্যপাল ঘোষণা করে দিলেন, তিনি বাংলা শিখতে চান। হাতেখড়িও হল ধুমধাম করে। তৃণমূল ভাবল একাধারে প্রাক্তন আমলা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ওই উপাচার্যকে তারা পকেটে পুরে ফেলেছে। বিজেপির সমর্থকরা হতবাক। কিন্তু একপক্ষকালের মধ্যে রাজ্যপাল নিয়ে মোহভঙ্গ হল‌ শাসকদলের। বিশেষ করে বিধানসভায় বিল পেশ করে রাজ্যপালের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য করে দেওয়ার যে ফাইল পাঠানো হয়েছিল, সেটিও আটকে দিলেন বোস। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনে সার্চ কমিটি তৈরির যে নিয়ম রাজ্য সরকার পেশ করেছিল সেটিও মানতে চাননি আচার্য রাজ্যপাল। তিনি জানিয়ে দেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি’র নিয়মই তিনি মানবেন। রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ আরও বাড়ল উপাচার্য নিয়োগের অনিয়ম সংক্রান্ত একটি মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের রায় বের হওয়ার পরে।

ওই রায়ে একসঙ্গে রাজ্যের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করে আদালত এবং তাঁদের সবাইকে পদ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তিতে তার কয়েক মাস আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালী চক্রবর্তীর নিয়োগ বাতিল করেছিল, সেই যুক্তিতেই হাইকোর্ট খারিজ করে দেয় রাজ্যের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগ। আর তার পরে রাজ্যপাল বনাম মুখ্যমন্ত্রী-শিক্ষামন্ত্রী বিরোধ চরমে ওঠে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে। আচার্যের নিয়োগ করা অস্থায়ী উপাচার্যদের মান্যতা দেয়নি রাজ্য শিক্ষা দপ্তর। স্থায়ী উপাচার্যের জন্য রাজ্য সরকার সার্চ কমিটি গড়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিল তার প্রশ্ন তুলে মামলা হয় কলকাতা হাইকোর্টে। সেই মামলা যায় সুপ্রিম কোর্টে।  সেখানে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে আচার্যের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সুপ্রিম কোর্ট সার্চ কমিটি গড়ার ফর্মুলাও তৈরি করে দেয়। সেই সার্চ কমিটি এখনও তৈরি হয়নি। আচার্যকে নতুন কোনও অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে বলে দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

তার ফলে কী হল? এর ফল হয় সুদূরপ্রসারী। আইন অনুযায়ী এক উপাচার্য পদত্যাগ করার পরেই স্থায়ী উপাচার্য তৈরির জন্য সার্চ কমিটি তৈরি করে ছয় মাসের মধ্যে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করতে হয়। অর্থাৎ  অস্থায়ী উপাচার্যদের কার্যকালের মেয়াদ ছয় মাস। কিন্তু মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়ায় এখনও সার্চ কমিটি তৈরি করা যায়নি। অস্থায়ী উপাচার্যদের অনেকেরই কার্যকালের এক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। রাজ্যের এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে বিত্ত আধিকারিক ছাড়া আর কোনও অফিসার নেই। একজনও স্থায়ী কর্মী নেই।

অস্থায়ী উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বা এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের (ইসি) বৈঠক ডাকার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। ফলে নিয়োগ, বেতন বৃদ্ধি, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ফাইলবন্দি। তৃণমূলের আমলে গাদা গাদা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে বটে, তার অনেকগুলিতেই নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী। রাজ্যের এক অনুন্নত এলাকায় নতুন গজিয়ে ওঠা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি যেখানে এই মুহূর্তে না আছন অস্থায়ী উপাচার্য, না রেজিস্ট্রার, না পরীক্ষা নিয়ামক। সহ উপাচার্যের পদ তৈরিই হয়নি কখনও। নেই একজনও স্থায়ী শিক্ষক। কীভাবে যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়ে চলেছেন বছর বছর তা ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু নয়।

সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারকে কথা বলে সমস্যা মিটিয়ে নিতে বলেছে। কিন্তু পরিস্থিতি মেটার দিকে এতটুকুও এগোয়নি। রাজার সরকার মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার দাবিতে এবং নিজের মতো সার্চ কমিটি গড়ার দাবিতে অটল। আচার্য নিজের অধিকার ছাড়বেন না। কটু কথার প্রতিযোগিতা চলছে।‌ এক শিক্ষাবিদের মন্তব্য, ‘অনেকের মতো আমারও মনে হচ্ছে রাজ্য সরকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির‌ দখল পেলে নিয়োগ সংক্রান্ত নিয়মনীতি বলে কিছু থাকবে না।’ উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরেও চাকরি চুরির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।‌ এক শিক্ষাবিদ বলেছেন, ‘সারা দেশে যে নিয়ম চলে, পশ্চিমবঙ্গে তার আলাদা ব্যবস্থা কেন থাকবে? ইউজিসি’র আর্থিক সাহায্য ছাড়া কি রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাঁচা সম্ভব?’ আচার্যকে পরোক্ষে সমর্থনই করছেন রাজ্যের ওইসব শিক্ষাবিদ।

এখন দেখা যাক রাজ্যপালের এক্তিয়ার কতটা। সংবিধান মোতাবেক, রাষ্ট্রপতির মতো এই রাজ্যপালও কার্যত ক্ষমতাহীন প্রধান। রাজ্যপালের অবশ্য কিছু বাড়তি ক্ষমতা আছে। যেমন রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করে ৩৬৫ ধারা জারির সুপারিশ করা।

তবে আচার্য হিসেবে রাজ্যপালের একটা আলাদা সত্তা যে রয়েছে তাতে দ্বিমত নেই। শিক্ষাবিদদের অনেকেই এই ‘রক্ষাকবচ’ রাখার পক্ষপাতী। কিন্তু প্রকাশ্যে রাজ্যপাল এবং শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন তাতে আচার্য পদের পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে, সন্দেহ নেই।‌

রাজ্যপাল বোসের এই অতিসক্রিয়তা নিয়ে অনেকে পূর্ববর্তী রাজ্যপাল ধনকরের উত্থানের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন।‌ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে তিনি এখন দেশের উপরাষ্ট্রপতি। ধনকরকে উপরাষ্ট্রপতি পদে বসাতে এ রাজ্যের শাসকদলের যে পরোক্ষ মদত ছিল তা বুঝতে কোনও গবেষণার দরকার পড়ে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেকে বলছেন, ধনকরকে আবার যেন পশ্চিমবঙ্গে চাপিয়ে দেওয়া না হয়, তার জন্য ওটা ছিল রাজ্যের শাসকদলের একটা চাল।

তবে একটা কথা মনে রাখা উচিত যে, ধনকর পুরোপুরি ছিলেন রাজনীতির মানুষ। আনন্দ বোস কিন্তু তা নন।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Bus Accident | খাদে বাস পড়ে মৃত ৪, আহত অন্তত ২০

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ল বেসরকারি বাস (Bus Accident)। ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত চারজনের। গুরুতর আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০ জন যাত্রী।...

Bihar | শাশুড়ি-জামাইয়ের বিয়ে, স্ত্রী দান শ্বশুরের

0
পাটনা: প্রেম মানে না কোনও বাধা। বয়স তো নয়ই। বয়সের বাধা নিয়ে অঙ্ক কষার মানে নেই প্রেমে। স্ত্রী মারা যাওয়ায় শাশুড়ির (Mother-in-law) সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা...

Kanpur | বাদ্যি বাজিয়ে বিবাহবিচ্ছিন্নাকে ঘরে ফেরালেন বাবা

0
কানপুর: বাদ্যি বাজিয়ে বিয়ে হয়। কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের পর ধুমধাম করে ব্যান্ড বাজিয়ে মেয়েকে ঘরে ফিরিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন কানপুরের (Kanpur) সরকারি আধিকারিক অনিল কুমার।...
cylinder blast in kishanganj

Cylinder Blast | কিশনগঞ্জে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দগ্ধ হয়ে মৃত ৩ শিশু সহ ৪

0
কিশনগঞ্জ: গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ (Cylinder Blast)। দগ্ধ হয়ে মৃত্যু হল তিন শিশু এবং এক মহিলার। ঘটনায় গুরুতর জখম হয়েছে আরও দু’জন। ঘটনাটি ঘটেছে কিশনগঞ্জের...

Bomb Threat | বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে! তিনটি স্কুলে হুমকি মেল

0
উত্তরবঙ্গ সংবাদ ডিজিটাল ডেস্ক: সাতসকালে বোমাতঙ্ক ছড়াল রাজধানীতে। দিল্লির তিনটি স্কুলকে (Delhi School) বোমা মেরে ওড়ানোর হুমকি (Bomb Threat) দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ইমেল...

Most Popular