জলপাইগুড়ি: ‘টিকিয়া’ শব্দটা শুনলেই প্রথমে মাথায় আসবে আলু টিকিয়ার কথা। গরম তাওয়ায় সেদ্ধ আলু মেখে নির্দিষ্ট আকার বানিয়ে তা ফ্রাই করে সরাসরি প্লেটে এবং তারপর শেষে মুখে। কিন্তু এই টিকিয়া সেই টিকিয়া নয়। এই টিকিয়ায় সামান্য আগুন দিয়ে উপরে ধুনো ছড়িয়ে দিলেই সুগন্ধি ছড়ায়। সন্ধ্যারতি কিংবা পুজোর অনুষ্ঠানে কাজে লাগে টিকিয়া। এই টিকিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এলাকার নাম। জলপাইগুড়ি পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের টিকিয়াপাড়ায় গেলে আজও দেখা যায় মাঠের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রোদে শুকোতে দেওয়া রয়েছে টিকিয়া৷ যার একমাত্র কারিগর টিকিয়াপাড়ার আয়েশা খাতুনের পরিবার। বংশপরম্পরায় সন্ধ্যারতির উপকরণটি তৈরি করছেন তাঁরা।
সুগন্ধি ধূপকাঠির যুগে আজও একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের কাছে যথেষ্টই মূল্যবান আয়েশাদের হাতে তৈরি টিকিয়া। এলাকার প্রবীণেরা জানান, ওই এলাকাতে বহু বছর আগে টিকিয়া বানাত ১৫-২০টি পরিবার৷ আর তা শহরের ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যেত৷ সেখান থেকেই এলাকার নাম হয়ে যায় টিকিয়াপাড়া৷ যাঁরা বানাতেন তাঁদের অধিকাংশই জীবিত নেই। আবার কেউ কেউ ভিনরাজ্য চলে গিয়েছেন কাজের খোঁজে৷ কেউ এই ব্যবসা থেকে সরে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। তবে, ওই এলাকায় একটিমাত্র পরিবার বংশপরম্পরায় টিকিয়ার ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন। বয়স ৮২ ছুঁইছুঁই আয়েশা খাতুন কাঁপা হাতে এখনও কখনও বড় ছেলেকে সাহায্য করেন টিকিয়া বানাতে। বয়সের ভারে শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি খুইয়েও পুরোনো অভ্যেসকে ভুলে যাননি। আয়েশা বলেন, ‘স্বামীর হাত ধরেই শিখেছিলাম। স্বামী মারা যাওয়ায় বড় ছেলেকে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়েছি।’
বাবার মৃত্যুর পর দায়িত্ব পেয়ে অর্থ উপার্জন করে দিব্যি সংসার চালাচ্ছেন মহম্মদ মনসুর। মনসুরের কথায়, ‘১০০০ পিস টিকিয়া ৪০০-৪৫০ টাকা করে বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা সন্ধ্যারতির সময় ধুনোয় এই টিকিয়া ব্যবহার করেন। লাভ মোটামুটি ভালোই হয়। কিন্তু বানাতে খুবই কষ্ট।’
কীভাবে বানানো হয় এই টিকিয়া? মনসুর জানান, ছোট ঝোপঝাড় কেটে এনে তা রোদে শুকোনো হয়। তারপর সেই শুকনো জঞ্জাল পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়। তারপর তা ঢেঁকিতে গুঁড়ো করতে হয়। সেই গুঁড়ো আটা দিয়ে বানানো আঠাতে মিশিয়ে বাতাসের মতো আকার বানিয়ে রোদে শুকোনো হয়৷ গুঁড়ো থেকে রোদে শুকোনো পর্যন্ত কাজে হাত মেলান ঘরের মহিলারা৷ মনসুরের ছেলে মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘বাবার মতো পারব কি না জানি না। তবে চেষ্টা করব পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখার।’
সত্যি আজও ওই এলাকায় গিয়ে ৮-৮০ সকলেই জানেন এখনও এই ব্যবসা ধরে রেখেছে আয়েশা খাতুনের পরিবার। ঝোপঝড় কাটা থেকে টিকিয়া তৈরি পর্যন্ত সময় লাগে প্রায় পাঁচদিন। শীতে শুকোতে সময় লাগলেও, বর্ষায় বানানো সম্ভব হয় না৷ তাই প্রতিদিন প্রায় ৪-৫ হাজার টিকিয়া বানিয়ে মজুত করে রাখে এই পরিবার।