সোমবার, ১৯ মে, ২০২৫

ভুটানের দূষণে মারণরোগ উত্তরবঙ্গের জনবসতিতে

শেষ আপডেট:

শুভঙ্কর চক্রবর্তী, পাশাখা (ভুটান) : ৩৫ বছর ধরে ভুটানের পাশাখা শিল্পতালুকের ৫০টিরও বেশি কারখানার দূষিত বর্জ্য, জল, ক্ষতিকর রাসায়নিক ছড়াচ্ছে ডুয়ার্সের নদী, বাতাসে। ভয়ংকরভাবে দূষিত হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জল। পাশাখার দূষণে লাগোয়া ভারতের সেন্ট্রাল ডুয়ার্স, তোর্ষা চা বাগান সহ দলসিংপাড়া, জয়গাঁ, হাসিমারা, কালচিনি এলাকায় সাধারণ মানুষ, চা বাগান শ্রমিকদের দেহে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে মারণরোগ।

ভুটান থেকে নেমে আসা বাসরা নদী সেইসব রাসায়নিক বয়ে নিয়ে ঢুকছে বক্সা ব্যাঘ্র-প্রকল্পের ভিতরে। ফলে ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়ছে বন্যপ্রাণীদের উপরেও। পাশাখা নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণায় এমনই ভয়াবহ নানা তথ্য তুলে ধরেছেন একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী। তারপরও সব জেনেবুঝে পাশাখায় কারখানা বাড়াচ্ছে ভুটান। পরিবেশকর্মীরা সোচ্চার হলেও পাশাখার দূষণ রোধে সরকারি স্তরে কার্যত কোনও পদক্ষেপই আজ পর্যন্ত হয়নি।

১৯৮৮ সালে পাশাখা শিল্পতালুক তৈরি করে ভুটান। ভারত ভূখণ্ড থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই অবস্থিত ভুটানের অন্যতম ওই শিল্পতালুক। ভুটানের সরকারি নথি অনুসারে পাশাখায় ৪৭টি কারখানা থাকলেও বাস্তবে সেই সংখ্যা ৫০ পার করেছে। পাশাখার দূষণে ভারতের ক্ষতি নিয়ে হইচই হওয়ায় ২০১৯ সালে একটি সমীক্ষা করে ভুটান সরকার। সে দেশের হয়ে সমীক্ষার কাজ করেছিল নতুন দিল্লির সংস্থা সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট। সেই সমীক্ষায় কীভাবে পাশাখার দূষণে ভারতের ক্ষতি হচ্ছে সেকথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। তারপরও পাশাখায় নতুন করে কয়েকটি ফেরি সিলিকন ও রাসায়নিক কারখানা খোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভুটান। সূত্রের খবর, চারটি বেসরকারি সংস্থা ইতিমধ্যেই কয়েক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তার ফলে প্রমাদ গুনছেন পরিবেশকর্মী ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা।

সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য বলছে, পাশাখা ও আশপাশের এলাকায় বাতাসে প্রতি কিউবিক মিটারে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম দূষিত পদার্থ রয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ সুমিত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, পাশাখায় কারখানা তৈরি জন্য আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মানা হয়নি। যেভাবে পাশাখা থেকে মাইক্রো সিলিকার গুঁড়ো বাতাস ও জলে মিশছে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। পাশাখা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ডের ভিতরেও মাইক্রো সিলিকা গুঁড়োর অস্তিত্ব মিলেছে। চা বাগান ও বনাঞ্চলে গাছের পাতার উপর মাইক্রো সিলিকার পুরু আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।

নদী ও বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের উপর যার সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পাশাখা নিয়ে অতি সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করেছে সমাজকর্মীদের সংগঠন নাগরিক মঞ্চ। তাদের সমীক্ষাতেও চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য উঠে এসেছে। মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নব দত্তের কথা, পাশাখা থেকে লাভবান হচ্ছে ভুটান। আর ক্ষতি হচ্ছে ভারতের। ডুয়ার্সের জল, বায়ু, মাটি সব ভয়ংকরভাবে দূষিত হচ্ছে। বাসরা বা কালজানি যে দূষিত জল বহন করছে সেই জলে সেচের কাজ হওয়ায় কৃষিক্ষেত্রেও দূষণের প্রভাব পড়ছে।

ভুটানের শিল্পমন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, বিনিয়োগ টানতে করোনার পর সেদেশে যে কয়েকটি শিল্প সম্মেলন হয়েছে প্রতিটিতেই পাশাখার জন্য নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব জমা পড়েছে। কেন পাশাখাতে বিনিয়োগ করতে এতটা আগ্রহী ভুটানি শিল্পপতিরা? ভুটান শিল্পমন্ত্রকের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় হওয়ায় আমদানি-রপ্তানির খরচ অনেকটাই কম হয় পাশাখায়। ভুটানের শিল্পতালুকগুলিতে অর্ধেকের বেশি শ্রমিক ভারতীয়। পাশাখায় কম মজুরিতে সহজেই প্রচুর ভারতীয় শ্রমিক পাওয়া যায়। পাশাখার একশো কিলোমিটারের মধ্যে সিমেন্ট, প্লাস্টিক, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ফেরি সিলিকন, স্টিল, ঠান্ডা পানীয়র মতো কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সহজলভ্য। তাই পাশাখায় বিনিয়োগের চাহিদা বাড়ছে। সূত্রের খবর, ইতালির একটি সংস্থা পাশাখায় ফেরি সিলিকন ইউনিট তৈরির জন্য বড় বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভুটানের শিল্পমন্ত্রক ইতিমধ্যেই তাদের জমিও দেখিয়েছে।

পাশাখা পরিদর্শনের পর উদ্বিগ্ন গবেষক ডঃ ছন্দা রায়ের কথা, পাশাখার দূষণে সেন্ট্রাল ডুয়ার্স, তোর্ষা চা বাগান ও আশপাশের এলাকার বাসিন্দাদের ফুসফুস, ত্বক ও পেটের দীর্ঘস্থায়ী রোগ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করেছে। ভূগর্ভস্থ এবং নদী-ঝোরার জল দূষিত হওয়ার ফলে এবং সেই জল নিয়মিত খাওয়ার ফলে মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়াগুলির জিনগত পরিবর্তন ঘটছে যা ভবিষ্যতের জন্য খুবই চিন্তার। এভাবে চলতে থাকলে ডুয়ার্সের জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। ফলে পাশাখা নিয়ে এখনই কড়া পদক্ষেপ জরুরি। হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের কোঅর্ডিনেটর অনিমেষ বসুর মতে, পাশাখার দূষণ ডুয়ার্সের একটা অংশ ও বক্সার বাঘবনকে গিলে খাচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারেরই উচিত দ্রুত পদক্ষেপ করা।

Sourav Roy
Sourav Royhttps://uttarbangasambad.com
Sourav Roy is a working Journalist since 2013. He already worked in many leading media houses in this few years. Sourav presently working in Uttarbanga Sambad as a Journalist & Sub Editor of Digital Desk from March 2019 in Siliguri, West Bengal.

Share post:

Popular

More like this
Related

Malda | বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হতেই কুপিয়ে খুন করা হল তৃণমূল কর্মীকে! শোরগোল মালদার রামকেলিতে

অরিন্দম বাগ, মালদা: জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ থেকে পরিকল্পনামাফিক ধারাল...

India-Bangladesh | বিপাকে বাংলাদেশ, বাণিজ্যে বিধিনিষেধে কর্মচ্যূতির শঙ্কা

উত্তরবঙ্গ ব্যুরো: একদিনেই হাহাকার অধিকাংশ স্থলবন্দরে। ভারত ও বাংলাদেশ-...

Lataguri | লাটাগুলিতে পর্যটকদের চায়ের আড্ডার আয়োজন, থাকবে লোকনৃত্য-প্রশ্নোত্তরের আসরও

শুভজিৎ দত্ত, নাগরাকাটা: এ-ও আরেক ‘চায়ে পে চর্চা’। ডুয়ার্সের...