- অমল সরকার
কী হবে বিহারে? জানতে আগ্রহী গোটা ভারত। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে রাজ্যের ৪০টি আসনের ৩৯টি দখল করেছিল বিজেপি-জেডিইউ-র এনডিএ জোট। একটি পেয়েছিল কংগ্রেস। ২০১৪-র পর ২০১৯-এও খাতা খুলতে পারেনি আরজেডি।
কিন্তু কী হবে এবার? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জেনে রাখা ভালো আগের দুই লোকসভা ভোটের সময় পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির মামলায় রাঁচির জেলে বন্দি ছিলেন লালুপ্রসাদ। আর ২০২৪-এ অসুস্থ আরজেডি সুপ্রিমো মাঠে-ময়দানে মিছিল-মিটিংয়ে না থেকেও একদা ‘ক্যায়া হ্যায় ইয়ে আইটি ফাইটি’ বলে নয়া প্রযুক্তিকে তাচ্ছিল্য করা লালুপ্রসাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলেছেন নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে। সেই আক্রমণে ঝাঁঝ এতটাই যে উপেক্ষা করতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রীও। যেমন ২০১৫-র বিধানসভা ভোটের সময় জামিনে মুক্ত লালুপ্রসাদ মোদি হাওয়া আটকে দিয়ে দলকে বিহার বিধানসভায় এক নম্বর স্থানে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এ তো গেল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর কথা। কী করছেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার? প্রকাশ্য মঞ্চে নরেন্দ্র মোদির পা ছুঁয়ে বিতর্কের পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আর এক মঞ্চে দেখা যাচ্ছে না জেডিইউ সুপ্রিমোকে। তাঁর ভুলে যাওয়া, অসংলগ্ন কথা বলার অসুখ ক্রমবর্ধমান। লন্ডনে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এলেও রোগ সারেনি মুখ্যমন্ত্রীর। ফলে ভোট মিটলে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে আর কতদিন তা নিয়ে সংশয়, সন্দেহ তীব্র হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, বিহারের কুর্সিতে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী এখন সময়ের অপেক্ষা। সেইসঙ্গে জেডিইউ ভেঙে একাংশ আরজেডি, আর এক অংশ বিজেপিতে চলে যাওয়া অসম্ভব নয়। উপর্যুপরি নয়বার শিবির বদল করে ‘সুশাসনবাবু’ থেকে ‘পাল্টুরাম’ আখ্যা পাওয়া নীতীশ কুমার ফের বিজেপির হাত ধরায় নিজের এতটাই বিপদ ডেকে এনেছেন যে অখুশি তাঁর অতি আপন অতিপিছড়া বা ইবিসি ভোটব্যাংক। তার জেরে বিজেপি-জেডিইউ সহ এনডিও শরিকেরা ধাক্কা খেতে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে, আরজেডি-বাম-কংগ্রেসের ভালো বোঝাপড়া এবং জোট সরকারের সময়ে লালুপ্রসাদ-পুত্র তৎকালীন উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বীর উদ্যোগে সরকারি অফিসে সাড়ে চার লাখ নিয়োগের কৃতিত্ব বিরোধীদের দিচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। ফলে বিহারে ভালো নেই মোদি-নীতীশের বোঝাপড়া।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এমনিতেই বিহারের সাড়ে তিন দশকের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে। রাজ্য থেকে জাতীয় রাজনীতিতে বিগত সাড়ে তিন দশকে বিহারের মুখ ছিলেন রামবিলাস পাসোয়ান, সুশীলকুমার মোদি, লালুপ্রসাদ যাদব এবং নীতীশ কুমার। বছর দুই আগে প্রয়াত হয়েছেন লোক জনশক্তি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা রামবিলাস পাসোয়ান। সদ্য ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে বিজেপি নেতা রাজ্যের আরেক প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীলকুমার মোদিকে। অন্যদিকে, কিডনি বদলের পর লালুপ্রসাদ এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। ময়দানে সক্রিয় থাকলেও নীতীশের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত তাঁর দল।
শুধু তাই নয়, নীতীশ বাদে সমসাময়িক তিন নেতার শূন্যস্থান পূরণ করছে নবীন প্রজন্ম। আরজেডির হাল ধরেছেন লালুপ্রসাদের ছোট ছেলে, নীতীশের আগের দুই মন্ত্রীসভার উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী।
অন্যদিকে, রামবিলাসের মৃত্যুর পর ভাই পশুপতি পারস এবং পুত্র চিরাগ পাসোয়ান আলাদা দল গড়েছেন। ২০১৯-এ দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রামবিলাস। এবার বাবার জায়গায় ময়দানে হাজির চিরাগ।
নীতীশের একমাত্র ছেলের সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই। তিনি মানসিকভাবে সুস্থ নন। অন্যদিকে, বিজেপি নেতা সুশীল মোদি নিঃসন্তান। দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর বিহার বিজেপির মুখ থাকা সুশীলের জায়গায় এই ভোটে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বয়সে নবীন সম্রাট চৌধুরী। তিনিই বিজেপির রাজ্য সভাপতি, একই সঙ্গে রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী।
বিগত তিন-সাড়ে তিন দশকে লালুপ্রসাদ, নীতীশ এবং সুশীলদের রাজনীতিতে হাতেখড়ি একই সময়, জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুবাদে। তিনজনই ছিলেন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্র নেতা। সুশীল মোদি ছিলেন বিদ্যার্থী পরিষদের। লালু ও নীতীশ একই সঙ্গে জনতা পার্টির ছত্রছায়া ছাত্র মোর্চার নেতা ছিলেন। একই সময়ে রাজনীতিতে উত্থান রামবিলাসেরও।
লক্ষণীয়, এই সোনালি অতীত ছাপিয়ে ভোটের বিহারে চর্চায় সেই লালুপ্রসাদ ও নীতীশ কুমার। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে লালুপ্রসাদ ঘোষণা করেছেন, এই নির্বাচনের পরই রাজনীতিতে নির্বাসনে যাবেন নীতীশ। তাৎপর্যপূর্ণ হল, লালুপ্রসাদের এই কথার তেমন প্রতিবাদ শোনা যায়নি বিজেপি এবং খোদ নীতীশের দল জেডিইউ থেকেও।
(লেখক সাংবাদিক)