- দেবদূত ঘোষঠাকুর
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় গড়িয়াহাটের দিক থেকে ফিরছিলাম। যাদবপুর থানা থেকে দেখলাম পুলিশ বাস ঘুরিয়ে দিচ্ছে ইএম বাইপাসের দিকে। মিছিল আসছে। কীসের মিছিল? এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘লালঝান্ডার’ মিছিল। ইনসাফ যাত্রা না কী যেন একটা হচ্ছে। রাস্তার ধারে টাঙানো পোস্টারটা এবার চোখে পড়ল। সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ইনসাফ যাত্রা। উত্তরবঙ্গ শেষ করে এখন দক্ষিণবঙ্গে চলছে শেষ পর্ব। ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে সমাবেশ। তারই প্রস্তুতি।
মনে পড়ে যাচ্ছিল ১২ বছর আগের শেষ মার্চের এক বিকেলের কথা। সেদিন গড়িয়ার দিক থেকে আসা সব গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পাটুলি দিয়ে বাইপাসের দিকে। কীসের মিছিল? সপার্ষদ ভোট প্রচারে বেরিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিন কিলোমিটার মিছিলের দৈর্য্য। মিছিলে এত মানুষের সমাবেশ দেখে বুদ্ধদেববাবু আঁচ পর্যন্ত করতে পারেননি যে, সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর শেষ নির্বাচন। মিছিল-মিটিংয়ে ভিড় মানেই যে তা ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হবে তা নয়, এতদিন তৃণমূল কংগ্রেস তা বুঝছিল। এই প্রথম তা বুঝতে পারল শাসকদল সিপিএম-ও। সেবার হটল ক্ষমতা থেকে। আর ২০১৯ সালের লোকসভা ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আসন নেমে এল শূন্যে।
এত দুর্দিন যে তাঁর জীবদ্দশাতেই হবে তা কি সেই সময় বুঝতে পেরেছিলেন বুদ্ধদেব? তাই যখন হল, তখন প্রশ্ন উঠল, সিপিএমের এত বড় সংগঠনের অস্তিত্ব কি অদূরভবিষ্যতে থাকবে? সিপিএমের নীচুতলাকে নিজেদের দিকে টেনে যে তৃণমূল পূর্ববর্তী শাসকদলের সংগঠনে এবং আত্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তবে বামপন্থী চেতনার আগুন যে ধিকিধিকি করে তখনও জ্বলছিল তার আভাস মিলছিল সিপিএমের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নবজোয়ার দেখে। সেটা আরও ভালো বোঝা গিয়েছিল ডিসেম্বরের ইনসাফ যাত্রায়। আর তা প্রমাণ হল ৭ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশেই।
যদি ইদানীং রাজ্যের বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর কথাবার্তা ভালো করে শুনে থাকেন, তবে খেয়াল করবেন, সিপিএম বলে যে একটা দল আছে তা গ্রাহ্যই করতেন না তিনি। একটি বাক্যও তিনি খরচ করতেন না পূর্বতন শাসকদলের জন্য। ইনসাফ যাত্রায় জেলায় জেলায় লালঝান্ডা নিয়ে মিছিলে মানুষ দেখে শুভেন্দু নম্বর দিতে শুরু করেছেন সিপিএমকে। আর ৭ জানুয়ারির ব্রিগেড সমাবেশের পরে তাঁর কথাবার্তায় তৃণমূল আর সিপিএমের গুরুত্ব অনেকটাই কাছাকাছি।
আর বিষয়টা অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ছিল তৃণমূলের কাছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম শূন্যে নেমে যাওয়ার পরে যাদের হারিয়ে বাংলার শাসনক্ষমতা তারা দখল করেছিল তাদের এখনও ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না। তবে তৃণমূল আর বিজেপি নেতৃত্ব একটা বিষয় বুঝে গিয়েছে যে, যুব সংগঠনের নিরিখে সিপিএম তাদের বলে বলে দশ গোল দিয়েছে।
বিজেপির যুব সংগঠন নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। সংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক, বিশাল কর্মসমিতি সব আছে। কিন্তু সংগঠন? অস্তিত্বের প্রমাণ পাইনি এখনও। তৃণমূলের যুব সংগঠনের ভিত কতটা মজবুত? তারা কি ডিওয়াইএফআইয়ের মতো এরকম একটা ব্রিগেড করতে পারবে? প্রবীণ এবং নবীন তৃণমূলের দুই প্রজন্মের দুই নেতা অকপটে জানিয়েছেন, ‘না এটা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।’ কেন? একসময় রাজ্য যুব কংগ্রেসের দায়িত্ব সামলানো এখন তৃণমূলের প্রথম সারির এক নেতার ব্যাখ্যা, আমরা বামফ্রন্টের আমলে যুব কংগ্রেসের ডাকে অনেক বড় বড় সমাবেশ করেছি। প্রথম দিকে প্রিয়দা, সুব্রতদা নেতৃত্ব দিতেন। পরে মমতাদি। সঙ্গে আমাদের মতো অনুগত লোকজন ছিল। একটা সংগঠন ছিল। এখন সংগঠন কোথায়?
কিন্তু দাদা-দিদির সভায় তো ভিড় হয় বিস্তর? তাও বলবেন সংগঠন নেই? ওই পোড়খাওয়া নেতা বললেন, ‘তৃণমূল স্তরে সংগঠক কই? কোনও না কোনও দাদার লেজুড়। সংগঠনের প্রতি আন্তরিক নয়। শুধু কামাতে এসেছে। কিছু দিতে নয়।’ কোনও ভালো সংগঠক থাকলে দলের ‘বোঝা’ এত বাড়ত না বলেও মনে করেন ওই তৃণমূল নেতা। ‘বেশির ভাগই শৌখিন রাজনীতি করে। ন্যূনতম রাজনৈতিক চেতনা পর্যন্ত নেই ওদের অনেকের’, মন্তব্য ওই নেতার। রাজ্য তৃণমূল যুবর বড়, মেজো, সেজো সব পদাধিকারীকেই এই দলে ফেলতে চান তিনি। রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন যুব নেতা না এলে ডিওয়াইএফআইয়ের মতো এমন সভা জেলা স্তরেও করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে তৃণমূলের সংগঠনে ‘রাজনৈতিক’ ব্যক্তিত্বদের বেশির ভাগেরই।
শুধু বিজেপি বা তৃণমূল নয়। এখানে প্রশ্ন উঠবে বামফ্রন্টের অন্য শরিকদলগুলোর যুব ছাত্র সংগঠন নিয়ে। আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক বা সিপিআইয়ের অবস্থা এমনিতেই খুব খারাপ। তাদের যুব ছাত্র সংগঠনের অবস্থা যে অতীব করুণ, এটা বলে দিতে হবে না। ডিওয়াইএফআইয়ের এমন সাফল্য, মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বা সৃজন ভট্টাচার্যের এমন দক্ষতা কতটা ভাবাচ্ছে অন্য বাম দলগুলোর যুব ছাত্র সংগঠনকে, সেটা একটা প্রশ্ন। তবে এই দলগুলোর জেলায় যা দুর্দশা, তাতে এদের শাখা সংগঠনের কিছু করে ওঠা খুব কঠিন। বামফ্রন্টের ওই দলগুলোকে বাম আমলের শেষদিকে দুর্বল করে দিয়েছিল সিপিএমই। এমন মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, আর জেগে ওঠা কঠিন। দুঃখের হল, এবারই শতবর্ষ চলছে সিপিআইয়ের কিংবদন্তি নেত্রী, মহিলা বিল তৈরির প্রথম হোতা গীতা মুখোপাধ্যায়ের। সেখানেই সিপিআই প্রায় শেষ।
কংগ্রেস এখন এ রাজ্যে টিঁকে আছে অতীতের স্মৃতিকে বুকে আগলে। এমতাবস্থায় যিনি নিজের ক্ষমতায় লড়ে যাচ্ছেন সেই অধীর চৌধুরীর নিশ্চয়ই যুব কংগ্রেসের বামফ্রন্ট বিরোধী আন্দোলনের দিনগুলির কথা মনে পড়ছে। ডিওয়াইএফআইয়ের ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘ওদের কিন্তু দম আছে।’ সিপিএম এখন এ রাজ্যে কংগ্রেসের দোসর। বন্ধুত্বের খাতিরে তিনি কিন্তু ‘দম’ কথাটি বলেননি। আসলে ‘দম’ কী জিনিস সেটা অধীরবাবু উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁর দম ছিল বলেই বামফ্রন্টের হাত থেকে বহরমপুর পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলেন। এখনও তিনি সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। একাই।
৭ জানুয়ারি ব্রিগেডের সভা বিজেপি এবং তৃণমূলকে তো বটেই, ৩৪ বছরের ‘শাসক’ সিপিএমকে একটা যেন বার্তা দিতে চাইল। এ যেন বদলের ডাক।
যুবদের মঞ্চে পাকাচুলোদের ঠাঁই নেই। পুরোনো ধ্যানধারণাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার দায় নেই। নতুন প্রজন্ম নতুনভাবে ভেবেছে। ৩৪ বছর রাজত্ব করা সিপিএমের এক নেতার বয়ান, ব্রিগেড শুনেছে হেঁই সামালো ধান হে, কাস্তেটা দাও শান হে, ব্রিগেড দেখেছে বিস্তর মানুষ, ব্রিগেড দেখেছে বফর্সের কমিশন। এই প্রথম ব্রিগেডে লাল সমাবেশে সব থেকে ওপরে উড়েছে তেরঙা পতাকা। বদল আরও আছে। ১৯৭৭ থেকেই ব্রিগেডে শক্তি প্রদর্শন বামেদের, এই প্রথম বিমান বসু সেখানে মঞ্চে নেই। দলের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে এক সময়ের কমরেড বলছিলেন, খুব ধীরে ধীরে একটা দল বদলায় সেটা দেখছি। ১৯৭৭ সালের সিপিএম আর ২০১১-র সিপিএম এক ছিল না। এবার দেখলাম ২০১১ আর ২০২৪-এর সিপিএমে ফারাক কতটা। এই কমরেডরা সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপির নাম শোনেননি। নতুন এক রাজনৈতিক দর্শনের হাত ধরে যেন এক নতুন সিপিএম জন্ম নিচ্ছে। বিজেপি-তৃণমূল-কংগ্রেস ও অন্য বাম দলের যুব নেতারা এই পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করতে পারছেন কি?
(লেখক সাংবাদিক)