- নীলাদ্রি বিশ্বাস
দিনকয়েক আগে কোচবিহার বইমেলার সাংস্কৃতিক মঞ্চে বসেছিল অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় নিয়ে আলোচনার আসর। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত কয়েকজন মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো জরুরি বর্তমান বিষয় নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া করলেন। ছোটবেলায় পড়া ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’ রচনাটি মনে পড়ছিল। সেসব না হয় ঠিক আছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সময়ের সঙ্গে মানব জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠছে। আর খুব দ্রুত তা তৈরি করে ফেলছে আশঙ্কার বাতাবরণ।
বইমেলার আলোচনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চাদরে জড়ানো শৈশবের কথা বলা হল। উঠে এল এআই শিক্ষক দিয়ে কৈশোর পরিচালনার কথা। সেখানেই মনের মাঝে একটা খোঁচা লেগে যায়। প্রচণ্ড দ্রুতগতির জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ধীরে ধীরে শিশুদের মনের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। যন্ত্র ভালো, বিজ্ঞানের আশীর্বাদসুলভ বিভিন্ন আবিষ্কার ভালো তো বটেই। কিন্তু যান্ত্রিকতাকে ভালো বলি কী করে? কচিকাঁচার দল অভিভাবকদের চাপে পড়েই যেন প্রাণ খুলে মিশতে ভুলে গিয়েছে। কেরিয়ার গড়বার নেশায় সাহায্য নিচ্ছে এআইয়ের বিভিন্ন অবতারের। সম্পর্কের সুতোগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে যেন।
অফিসের এক সিনিয়ার দাদার ছেলে স্পেস রিসার্চ নিয়ে ব্যস্ত। বন্ধু-আত্মীয়র সঙ্গের তুলনায় ওর পছন্দ এআই শিক্ষকের সান্নিধ্য। ওর বাবা সেদিন দুঃখ করে বলছিলেন, ‘এ ছেলে কী করে যে আর সামাজিক হবে!’ আত্মীয়স্বজন সামাজিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে এই অতি আধুনিক প্রজন্ম। ধীরে ধীরে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যকেও এরা মাপতে চাইছে যান্ত্রিকতার নিক্তিতে। মুঠোফোনের মতো প্রচণ্ড প্রয়োজনীয় বস্তুটি এ মুহূর্তে অবশ্যই সংবাদ শিরোনামে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে এর অপব্যবহারের অভিশাপে।
আধুনিক পৃথিবীকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার তাগিদে বিজ্ঞান হয়তো এআইকে আরও ক্ষুরধার করে তুলছে। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের কাজের সম্ভাবনা। বেকার হচ্ছে স্কিল্ড হিউম্যান ব্রেন। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে ধনকুবের এবং নিরন্ন মানুষের দল। মুছে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এআইয়ের কুপ্রভাব পড়ছে উত্তরবঙ্গে। মানবজাতির উপকার করতে গিয়ে যান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হৃদয়ের বাঁধনকেও আলগা করে তোলা হচ্ছে।
উন্নততর পৃথিবী এর ফলে কতটা লাভবান হবে? যন্ত্রমানব কিংবা যান্ত্রিক মানুষ দ্বারা পরিচালিত সমাজ ঠিক কতটা স্বস্তির অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছড়িয়ে পড়া তাই নিশ্চিন্ততার বাতাবরণ তৈরি করতে দেয় না। একথা এর সঙ্গেই অস্বীকারের উপায় নেই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই মুহূর্তে হয়ে উঠেছে একটি প্রয়োজনীয় অ্যাকাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র। আর ভয়টা সেখানেই। ছোটদের জন্য যেন ভবিষ্যতের অশনিসংকেত। সে কারণেই সঠিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। প্রয়োজনীয় বিষয় হয়েও যাতে এটি ‘বাঁদরের হাতে খন্তা’ তুলে দেওয়ার মতো না হয় তা নিয়ন্ত্রকদেরই দেখতে হবে।
আগামী প্রজন্ম এ মুহূর্তে ভাসছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দামাল সাগরে। ডুবে না গিয়ে মাথা উঁচু রেখে সমাজকে সঠিক দিশা তারা দেখাতে পারবে কি? মানবিক সম্পর্কেরা তা জানার অপেক্ষায়।
(লেখক কোচবিহারের সংস্কৃতিকর্মী)