Friday, May 17, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়বাবরি থেকে রাম মন্দির: লাভ-ক্ষতির গল্প

বাবরি থেকে রাম মন্দির: লাভ-ক্ষতির গল্প

যে শহরের মন্দির-মসজিদ বিবাদ ঘিরে ধর্মীয় বিভাজন দেশজুড়ে, সেখানে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এককথায় অতুলনীয়

  • অমল সরকার

অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের দিন গোটা দেশে ঘরে ঘরে প্রদীপ প্রজ্বলনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আরএসএস নেতারা চান, মুসলিমরাও সমস্বরে ‘জয় শ্রীরাম’ বলুন। গত শনিবার অযোধ্যার নয়া বিমানবন্দরের প্রথম উড়ানের পাইলট যাত্রীদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলে সম্বোধন করেছেন। সেই বিমানবন্দর উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রামলালা বহুদিন অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছেন। এবার পাকা ঘর অর্থাৎ রাম মন্দিরে তাঁর অধিষ্ঠান হতে চলেছে।’

‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, ২২ তারিখ মন্দির উদ্বোধনের দিন রামকে নিয়ে সমাজমাধ্যমে কবিতা, গল্পের হ্যাশট্যাগ প্রচারে ট্রেন্ড তৈরি করুন।

হলফ করে বলতে পারি, রাজনীতি প্ররোচিত এই উন্মাদনা থেকে অনেকটাই দূরে থাকবে রাম-রাজনীতির গর্ভগৃহ অযোধ্যাবাসীর বেশিরভাগ মানুষ। ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে-পরে বহুবার এই শহরে গিয়েছি। খাস অযোধ্যায় রামের নামে রাজনীতি প্রত্যক্ষ করিনি। যে শহরের মন্দির-মসজিদ বিবাদ ঘিরে গোটা ভারত ধর্মীয় বিভাজনে বিধ্বস্ত, সেখানে অযোধ্যায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক এককথায় অতুলনীয়। বাবরি ধ্বংসের দিনে আহত হিন্দু করসেবকদের অনেককেই স্থানীয় মুসলিমরা শুশ্রূষা করেছেন। এককথায়, অযোধ্যাবাসীর মনে রাম আছেন, দেবতাকে নিয়ে রাজনীতি নেই।

২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সেখানে মন্দির উদ্বোধন করবেন। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে রাষ্ট্রপ্রধানের উপাসনাস্থল উদ্বোধন করা উচিত কি না সেই বিতর্ক পঁচাত্তর বছর ছুঁতে চলল। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আপত্তি উড়িয়ে সংস্কার হওয়া সোমনাথ মন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। তা নিয়ে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পত্রযুদ্ধ কমবেশি অনেকেই জানেন। বেশিরভাগের অজানা রাম মন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কে নেহরুর ভূমিকা।

১৯৪৯-এর ২১-২২ ডিসেম্বর রাতে বাবরি মসজিদের তালা ভেঙে রামলালার মূর্তি রেখে আসার ঘটনা জানতে পেরে নেহরু মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘অযোধ্যার ঘটনাবলির খবর পেয়ে আমি খুবই বিরক্ত বোধ করছি। আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে আপনি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ঘটনাটি খুবই বিপজ্জনক এবং পরিণতি খুবই খারাপ হতে পারে।’ সেই চিঠি লখনউয়ে পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী পন্থ এবং ফৈজাবাদের জেলা শাসক কেকে নায়ার হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। ফৈজাবাদ আদালতের নির্দেশে তখন থেকে বাবরির তালা বন্ধই ছিল। আজ সেই নেহরু নেই, নেই তাঁর কংগ্রেস।

২০২০-র ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছয়শো বছরের পুরোনো সেই বাবরি মসজিদের জমির উপর যখন রাম মন্দিরের শিলান্যাস করছেন তখন রাজীব-কন্যা প্রিয়াংকা গান্ধি টুইটে দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রয়াত পিতার কৃতিত্ব।

রাজীবের কোন কৃতিত্ব দাবি করছেন প্রিয়াংকা? প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীবই তাঁর পিতামহের নির্দেশে বন্ধ থাকা বাবরির তালা খোলার ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৮৬-তে শাহবানু মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় (স্বামী তালাক দেওয়া স্ত্রীকে খোরপোশ বাধ্য) ঘিরে মুসলিম মৌলবাদীদের চাপে রাজীব সংসদে বিল এনে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ খারিজ করে দেন। সেই সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার করে হিন্দুদের মুসলিম তোষণের অভিযোগের মুখে দিশেহারা রাজীব বাবরির তালা খোলার ব্যবস্থা করেন।

আজ ফুলে-ফলে পল্লবিত বিজেপির বয়স তখন মাত্র ছয়। দলের দুই কান্ডারি অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদবানিরা বুঝলেন, অযোধ্যা অস্ত্র ব্যবহারের এই মোক্ষম সময়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে আগে থেকেই আন্দোলন চালিয়ে আসছিল। ১৯৮৯-এর সেপ্টেম্বরে হিমাচলপ্রদেশের পালানপুরে আদবানি, বাজপেয়ীরা প্রস্তাব গ্রহণ করলেন রাম মন্দিরের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন করবে বিজেপি। সেই থেকে রাম হয়ে গেলেন রাজনীতির আইকন। পরের বছর গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যা অভিমুখে রামরথ ছোটালেন আদবানি।

সেই বাবরি মসজিদ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বিধ্বস্ত হওয়ার দিনে দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর এক কংগ্রেসি প্রয়াত নরসীমা রাও। মাসকয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন ফৈজাবাদের জনপ্রিয় দৈনিক জনমোর্চার সম্পাদক শীতলা সিং। তাঁর মুখে বহুবার শুনেছি, ১৯৯২-র অভিশপ্ত দিনটিতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসকে ফোনে জানিয়েছেন কীভাবে প্রাচীন সৌধকে পুলিশ ও আধাসেনার সামনে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কথায় কথায় আরও বলেছিলেন, ‘বাবরির আসল কবর খুঁড়েছিলেন রাজীব, বন্ধ মসজিদের তালা খোলার ব্যবস্থা করে দিয়ে।’

প্রধানমন্ত্রী রাও সেদিন কী করছিলেন? মন্ত্রী মাখনলাল ফোতেদার ছাড়া তিনি সেদিন কারও ফোন ধরেননি। রাও মন্ত্রীসভার সদস্য কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ ফোতেদার তাঁর ‘দ্য চিনার লিভস’ বইয়ে লিখেছেন, বাবরির তৃতীয় গম্বুজটি ভেঙে ফেলার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোনে অনুরোধ করে ছিলেন ফৈজাবাদ থেকে সেনা পাঠাতে। রাও রা কাড়েননি। আর সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের আত্মজীবনী ‘বিয়ন্ড দ্য লাইনস’-এ আছে, ‘ওইদিন প্রথম গম্বুজটি ভাঙা শুরুর পর রাও পুজোয় বসেন, ওঠেন তৃতীয়টি ভেঙে ফেলার পর।’

দিনটি ছিল রবিবার। ফোতেদার ছাড়া মোটের উপর ছুটির মেজাজেই ছিলেন রাওয়ের মন্ত্রীরাও। ফলে বাবরি ধ্বংসের কলঙ্ক শুধু বিজেপি নয়, কংগ্রেসের গায়েও আছে। সেই সুবাদে রাম মন্দির নির্মাণের কৃতিত্বও দু’পক্ষই দাবি করতে পারে। তবে বিজেপির বিভাজন রাজনীতির তীব্র সমালোচকরাও মানবেন, পদ্ম শিবির এই ব্যাপারে কথায় ও কাজে বরাবর স্পষ্টবাদী। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে যখন যেমন, তখন তেমন অবস্থান নিতে নিতে কংগ্রেস আজ মাটিহারা। বাবরি ধ্বংসের পর মুসলিম সমাজের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় সংখ্যালঘুর সুরক্ষায় নেহরুর মতো ঢাল কংগ্রেসে আর নেই। তারা তাই আঞ্চলিক দলগুলিকে অবলম্বন করে।

আজ মন্দির উদ্বোধনের প্রাক্কালে প্রশ্ন স্বাভাবিক, মন্দির-মসজিদ বিতর্কে কার লাভ কার লোকসান। মাত্র ৪৪ বছর বয়সি বিজেপি ৩৫ বছর আগে ১৯৮৯-এ রাম মন্দির নির্মাণের দাবিকে দলীয় অ্যাজেন্ডা করে বাজপেয়ী ও মোদিকে মিলিয়ে দেড় দশকের বেশি দেশ শাসন করে ফেলল।

সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা বিবাদের মীমাংসা করলেও বিজেপি-সহ হিন্দুত্ববাদী শিবিরের কৃতিত্ব তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না। বাজপেয়ী, আদবানিরা দলের যে তিনটি সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন, তাতে অযোধ্যা ছাড়াও ছিল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর বাতিল হওয়া। তিন তালাক বিরোধী আইনে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বাকি অনেকটাই সম্পন্ন। এই তিনের মধ্যেই নিহিত বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণার সংকল্প, যার নিছকই ঘোষণাটুকু বাকি।

কিন্তু কংগ্রেস? মন্দির উদ্বোধনের আমন্ত্রণ পেয়েও সোনিয়া গান্ধি, মল্লিকার্জুন খাড়গেরা তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করছেন না। আসলে কংগ্রেসের শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থা। সোনিয়া নিশ্চয়ই ভাবছেন, রাম মন্দির নিয়ে তাঁর প্রয়াত স্বামীর অবদান মুছে যেতে পারে ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় না গেলে। আবার কংগ্রেসি জমানায় বাবরি ধ্বংস তাঁকে মুসলিম ভোট নিয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

শুধু কি কংগ্রেস? রাজ্যে রাজ্যে অবিজেপি সরকারগুলির মন্দির নির্মাণ, গঙ্গা আরতি, ক্লাবকে পুজো অনুদানের মতো কর্মসূচি নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলিও বকলমে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতিকেই আঁকড়ে ধরেছে। বাবরি ধ্বংস দেশের সমাজ ও রাজনীতির ডিএনএ বদলে দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী মানেই দেশপ্রেমিক, এমন ধারণা এখন রাষ্ট্রস্বীকৃত। তবে হিন্দি বলয়ের সদ্য অনুষ্ঠিত তিন রাজ্যের ভোটে কংগ্রেসের পরাজয়, বিজেপির বিপুল বিজয় প্রমাণ করে নকল হিন্দুত্বে মানুষের আস্থা কম।

রাজীব শুধু বাবরির কবর খুঁড়েছিলেন তাই-ই নয়, কংগ্রেসের কৃপায় মাত্র ২২৩ দিন প্রধানমন্ত্রী থাকা চন্দ্রশেখরের মন্দির-মসজিদ বিবাদের আপস মীমাংসার রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান প্রাক্তন সাংবাদিক হরিবংশ তাঁর ‘চন্দ্রশেখর, দ্য লাস্ট আইকন অফ ইডিওলজিক্যাল পলিটিক্স’ এবং রডরিক ম্যাথুর ‘চন্দ্রশেখর অ্যান্ড দ্য সিকস মানথস দ্যাট সেভড ইন্ডিয়া’ বই দুটিতে অযোধ্যা বিবাদ মীমাংসায় চন্দ্রশেখরের উদ্যোগ লিপিবদ্ধ আছে।

মীমাংসা সূত্রের একটি প্রস্তাব ছিল মসজিদের পাশেই তৈরি হোক একটি হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির। আর থাকবে সর্বধর্ম চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। ফলে অযোধ্যা কী হতে যাচ্ছে তা আমরা দেখতে পারছি। কী হতে পারত, তাও স্মরণে রাখা জরুরি।

(লেখক সাংবাদিক)

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

Siliguri | প্রতিস্থাপন ও রোপণ নিয়ে পুরনিগমের অন্দরে বিরোধ, ৫০০ গাছে কোপ শহরে

0
শিলিগুড়ি: উন্নয়নের রাস্তায় বলি হচ্ছে গাছ। গত এক বছরে শিলিগুড়ি শহরে কোপ পড়েছে অন্তত ৫০০ গাছে। কোথাও একেবারে গোড়া সমেত কেটে ফেলতে হয়েছে বিশালাকার...

আমেরিকার চোখে ভারতের নির্বাচন

0
শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায় বনধোয়ানির জঙ্গলে জন্মদোষে শাস্তিপ্রাপ্ত শিশুটিকে কোলে নিয়ে, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদরী’ বলেছিলেন, ‘আমি খ্রিস্টান নই গো বাপ’! এরকম...

শখের বাগানে ৭২ প্রজাতির আম ফলিয়ে তাক লাগাল আলিপুরদুয়ারের প্রিয়রঞ্জন

0
আলিপুরদুয়ার: কী আম নেই তাঁর বাগানে! ডুয়ার্সের মতো মাটিতে দেশি-বিদেশি সহ মোট ৭২ প্রজাতির আম ফলিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের প্রিয়রঞ্জন দেব ওরফে লোচা।...

শিলিগুড়ির জলসমস্যা ও জনসমস্যা

0
সন্দীপন নন্দী বাগডোগরা বিমানবন্দরে অবতরণকালে এ শহরকে নিমেষে দেখলে মনে হয় যেন এক হুবহু খেলনানগরী। আশ্চর্য! যে নয়নাভিরাম দৃশ‍্যে তিস্তা স্থির, শান্ত একটি নদী।...

PM Narendra Modi | কাশীতে এখনও মোদিই কালভৈরব

0
রূপায়ণ ভট্টাচার্য, বারাণসী: দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে বোর্ডিং হাউসের তিন নম্বর ঘরের জানলা থেকে ফেলুদা-জটায়ু-তোপসে যে রাস্তাটা দেখেছিলেন, তার সঙ্গে এখনকার কোনও মিল নেই। স্বাভাবিক।...

Most Popular