- মাধবী দাস
কয়েকদিন আগেই ‘উত্তরের হাওয়া’ শিরোনামে কোচবিহার এবিএন শীল কলেজ প্রাঙ্গণে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। উত্তরবঙ্গের সাহিত্য মহলের আবেগকে বুঝতে পেরে, দেরিতে হলেও এই সিদ্ধান্ত সাধুবাদ দাবি করে। ২০১৩ সালে সরকার পরিবর্তনের পর উত্তরবঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন মেলার দীর্ঘ বিরতি থাকায় কোচবিহারের ‘তোর্ষা সাহিত্য সংস্থা’ সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে ২০১৫ সালে উত্তরবঙ্গের বুকে প্রথম শুরু করেছিল লিটল ম্যাগাজিন মেলা। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ এমনকি বাংলাদেশ, ত্রিপুরা থেকেও প্রতি বছর সম্পাদকেরা আসেন এই মেলায়।
গত তিন বছর থেকে ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য আকাদেমি’ নাম দিয়ে উত্তরবঙ্গের সাহিত্যপ্রেমী কয়েকজন তরুণ বিভিন্ন জেলায় ঘুরে লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করে চলেছেন। এ বছর তা জলপাইগুড়ি জেলায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল।
মেলাগুলোতে কিছু আলোচনা ও স্বরচিত কবিতা পাঠ ছাড়া আর কিছুই নজরে আসেনি। আলোচনা সভা শ্রোতাদের কতটা ঋদ্ধ করতে পারে সেই প্রশ্নে না গিয়েও এটা বলাই যায়, সাহিত্যপ্রেমীদের মনে কিছু আলোড়ন তো তোলেই। যে আলোড়ন নতুন নতুন প্রশ্নের, নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়। জন্ম দেয় আরও কিছু পত্রিকার। বড় মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত কবিদের পাশে সদ্য লিখতে আসা কবিরা ডাক পেলে, লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। তবে সবক্ষেত্রেই কিছু ছাঁকনি প্রয়োজন। অথচ নাজিম হিকমতের বিখ্যাত সেই পংক্তির সঙ্গে সমভাব পোষণ করেই সবাই সান্ত্বনা পাই–‘মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই। সে কথা আজও আমি বলিনি।’
হয়তো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর যে কবিতাটি আজ পর্যন্ত লেখা হয়নি। সেই লেখাটি কেউ লিখে ফেলবে কিংবা কবির মনে সেই অমোঘ তৃষ্ণা জেগে উঠবে!
এতসব আশাবাদের পরেও সমস্যা থেকেই যায়- সেই অর্থে বিক্রি নেই পত্রিকার। মেলাকে কেন্দ্র করে জমায়েত, মেলবন্ধন, প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবিদের সঙ্গে ছবি তোলা আর পত্রিকা বিক্রির অনুপাতের বিস্তর ফারাক। স্টলে স্টলে ঘুরে লেখক সংখ্যা সংগ্রহ করাই যেন মূল লক্ষ্য। একটি সংখ্যা কিনে অন্যকে উপহার দেওয়ার মানসিকতাও চোখে পড়ে না।
লিটল ম্যাগাজিন মানে এখনও অনেকেই বিশ্বাস করেন, লেখক ও কবির আঁতুড়। অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কত উন্নত সাহিত্য পেয়েছি আমরা। এখনও মাঝে মাঝে পাই উন্নত সাহিত্য। তথ্যভিত্তিক কিছু বিশেষ সংখ্যা ও আঞ্চলিক ইতিহাস সমৃদ্ধ কিছু পত্রিকা সংগ্রহযোগ্য বটে। তবে কল্লোল, কালিকলম, জিরাফ, কৌরব বা কৃত্তিবাস, কবিতাপাক্ষিকের মতো এখন আর সময়কে ভাঙচুর-করা সাহসী পত্রিকা খুব একটা নেই। চোখে পড়ে না পত্রিকা করার দায়ে জেলখাটার মতো নবীন কিশোরদের। জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটার নেশায় আদর্শচ্যুত এই সময়ের বেশিরভাগ পত্রিকা। কম সময়ের মধ্যে এঁরা আবার প্রকাশক হয়ে উঠছেন।
বহু পত্রিকা সম্পাদনা শব্দটির অর্থ ভুলে গিয়ে অপরিণত ও প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবির বাঁহাতের লেখা নিয়ে ছাপছে বলেই প্রকৃত পাঠক দিনে-দিনে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। মেলার সার্থকতা তখনই থাকবে, যখন উদ্যোক্তারা বোঝাতে পারবেন কাজের মানদণ্ড অনুযায়ী নির্বাচন পেতে পারে একটি পত্রিকা। বোঝাতে পারবেন আঁতুড় নয়, লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যসাধনার আশ্রম।
(লেখক কোচবিহারের শিক্ষক ও সাহিত্যিক)