Tuesday, May 14, 2024
Homeউত্তর সম্পাদকীয়কুলদীপরা স্মৃতিতে, শাহজাহানরা নয়

কুলদীপরা স্মৃতিতে, শাহজাহানরা নয়

শাহজাহানের মতো লুম্পেন সর্বত্র। ‘লুম্পেনপ্রলেতারিয়েত’ শব্দের সংজ্ঞাও পালটেছে। মাওবাদ থেকে হিন্দুত্ববাদে।

  • রূপায়ণ ভট্টাচার্য

বহু বহু যুগ আগে মালদা স্টেশনের কাছে ওয়াগন ব্রেকারদের হাতে খুন হয়ে যান তরুণ কুলদীপ মিশ্র। ঝলঝলিয়ার বড় রাস্তায়।

ডিওয়াইএফআই করতেন। তবে রাজনীতির থেকেও আসলে বেশি করতেন ‘মানুষনীতি’। কলেজে গ্রাম থেকে ছেলে এসে সমস্যায় পড়লে ত্রাতা হয়ে উঠতেন কুলদীপ। জেলার লোককে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দরকার হলে ছুটতেন সবার আগে। হকারদের সমস্যাতেও তিনি। পার্টির থেকেও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মনুষ্যত্ব।

এখন এমন হিসেববিহীন পরোপকারী লোক মেলেই না সমাজে।

ওয়াগন ব্রেকারদের বিরুদ্ধে সরব কুলদীপ সক্রিয় হয়ে ওয়াগন ব্রেকিং বন্ধ করে দেন। তাদের সব গোষ্ঠী একবার সমস্যা মেটাতে ডাকে কুলদীপকে। সেখানেই খুন হয়ে যান তিনি।

মালদা, এনজেপি, আলিপুরদুয়ার থেকে হাওড়া, বর্ধমান, আসানসোল- বড় রেল শহরে ওয়াগন ব্রেকারদের দাপট নেই আর। মালগাড়ির চেহারা পালটেছে। নিরাপত্তা অনেক ভালো আলোকোজ্জ্বল স্টেশন চত্বরে। মিটিংয়ের নামে ডেকে মানুষ খুন করার লোকেরা থেকে গিয়েছে অন্য রূপে। অন্য পেশায়। খুন না করলেও এমন বিরক্ত করছে, যা খুন করার শামিল।

সন্দেশখালির শাহজাহানের দাপট শুনে এই কথাগুলো মেলানো যায় আবার। এমন নয় যে শাহজাহান একজনই এবং তাঁর অস্তিত্ব শুধু এই সরকারের আমলে। এমন দলবদলিয়া লুম্পেনতন্ত্র বহু বছর ধরেই দেখে আসছে বাংলা এবং ভারত। লুম্পেনরাই লুম্পেনদের সংজ্ঞা পালটেছেন নিজেদের স্টাইলে। নিজেদের রবিনহুড ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন নিজস্ব লোক তৈরি করে, অনেক গরিবকে সাহায্য করে। আবার উলটোদিকে খুন করা, লোকের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া অভ্যাস করেছেন। মুম্বইয়ের হাজি মস্তান, দাউদ ইব্রাহিম, ছোটা রাজন, কলকাতার গোপাল পাঁঠা, রাম চ্যাটার্জি, ফাটা কেষ্ট, হেমেন মণ্ডল, মীর মহম্মদ ওমর এক একজন মিথ। ওমরকে তো খুঁজেই পায়নি পুলিশ।

দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, একেবারে কোণে কোণে এমন লোক পাবেন বাবুমশাইরা। কেউ মাফিয়া হিসেবে আন্তর্জাতিক উত্তরণ ঘটিয়েছে দাউদের মতো। কেউ ফাটা কেষ্টর মতো পাড়ার লোক হয়েই থেকেছে। কেউ রাম চ্যাটার্জির মতো মন্ত্রী হয়ে উঠেছে পর্যন্ত। বাম-তৃণমূল, দুই আমলেই কলকাতার কিছু মন্ত্রীর কাছে দরিদ্ররা সাহায্য চাইতে এলে ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী, প্রোমোটাররা আতঙ্কে থাকতেন। এই শুনতে হবে, ‘অমুকের কাজ রয়েছে। ওর জন্য সাহায্য পাঠিয়ে দাও।’

নেতাদের যুক্তি সহজ, মাছের তেলে মাছ না ভাজলে সাহায্যের টাকা উঠবে কী করে? এটা ভেবে দেখতেন না, ওই টাকা পালটা তুলতে সাধারণের ওপর কত অত্যাচার চালাত মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ প্রোমোটার। এভাবেই পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে নাকতলায় তৈরি হয়েছিল চরম প্রতারক প্রোমোটারচক্র। যাঁরা গরিব লোকদের ঠকিয়েছেন। মন্ত্রী মুখ বুজে ছিলেন।

খেয়াল করে দেখুন, আসমুদ্রহিমাচল এই লুম্পেন তৈরির পিছনে এক একজন রাজনৈতিক নেতা। স্বাধীনতার পর থেকেই। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের আশীর্বাদের হাত মাথায় না থাকলে যেমন শাহজাহানের শাহজাহান হয়ে ওঠা হত না, তেমন অধিকাংশ লুম্পেন আরও আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন নেতাদের হাত ধরে। বাংলার বড় বড় নমস্য নেতাদের অনেকেরই এমন লোক ছিল। নেতারাই তাদের ব্যবহার করেছেন নিজেদের কাজে। তারপর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠেছে। আর সামলানো যায়নি অনুব্রত-কাজল-আরাবুলদের।

রাম চ্যাটার্জি কীভাবে চরম দক্ষিণপন্থী থেকে বামপন্থী মন্ত্রী হয়ে উঠলেন, সেটা এক গল্প। হুব্বাকে নিয়ে মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সাম্প্রতিক সিনেমার থেকেও রাম-জীবন রোমাঞ্চকর হতে পারে সিনেমা হিসেবে। রাম যখন রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালাচ্ছেন চন্দননগরে, তখন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়েছিলেন সেখানকার কিছু স্থানীয় নেতা। শুনে এক বহুখ্যাত বাম নেতা শুধু বলেছিলেন, ‘আমরা তো কখনও বলিনি, রামের ডান হাতটা ভেঙে দিও না।’ মূলত সবুজ সংকেত। তার পরের দিনই প্রকাশ্যে বেধড়ক মার খেয়েছিলেন রাম।

এমন ঘটনা, আবার বলি, কাশ্মীর থেকে কুমারিকা ছড়িয়ে। প্রতিটি রাজনৈতিক পার্টির অন্দরে। জাতীয় স্তরে অধিকাংশ নমস্য নেতার হাতেই লেগে এই কালো দাগ। কাকে ছেড়ে কার কথা লিখি, ভাবতে গিয়ে আর লিখলাম না।

লুম্পেন মানে আসলে কী? খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, গুন্ডাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের মতো লুম্পেনের সংজ্ঞাও পালটেছে। লুম্পেন মানে কী? কেমব্রিজ অভিধানে বলছে, ‘লুম্পেন মানে সেই ধরনের লোক, যারা বু‌দ্ধিমান নয়। শিক্ষিত নয়। যারা নিজেদের পরিস্থিতি পালটানোর, উন্নয়নের জন্য আগ্রহী নয়।’ মিরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধানে এর মানে, ‘যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে বিচ্যুত।’ আবার রাজনৈতিক দিক থেকে শব্দটার মানে পালটে গিয়েছে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, ট্রটস্কি, মাও সে তুংয়ের কথা ভাবলে।

১৮৪০ নাগাদ মার্কস ও এঙ্গেলস তৈরি করেন ‘লুম্পেনপ্রলেতারিয়েত’ নামে একটা শব্দবন্ধ। সমাজের শোষিত দরিদ্রের কথা ভেবে, যেখানে ক্রিমিন্যাল ও ভ্যাগাবন্ড সবাই হাজির। দুই তাত্ত্বিক বলেছিলেন, লুম্পেনপ্রলেতারিয়েতদের দিয়ে বিপ্লব করানো যাবে না। পরে লেনিন-ট্রটস্কিও একমত হন মার্কসের সঙ্গে। পরে চিনে মাও অবশ্য মার্কস-লেনিনের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, নেতারা বুদ্ধি করে লুম্পেনপ্রলেতারিয়েতদের ব্যবহার করতেই পারেন। এখন দেশদুনিয়া যা দেখি, তাতে মনে হচ্ছে, মাওই বেশি ‘বুদ্ধিমান’ ছিলেন।

বাংলায় নকশাল আমলে ‘লুম্পেন’ কথাটা তুলেছিলেন সেসময়ের কলকাতা পুলিশের নগরপাল, পরে রাজ্য পুলিশের ইনস্পেকটর জেনারেল রঞ্জিত গুপ্ত। তিনি বলেছিলেন, ‘মাওবাদী নকশালদের মধ্যে ছিল কিছু ইন্টেলেকচুয়াল, কিছু লুম্পেনপ্রলেতারিয়েত। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল পুলিশ। তারা ভেবেছিল, পুলিশ ফোর্সকে ভাঙলে সমাজব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া যাবে।’ বহু বছর পরে ২০০১ সালে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অতুল কোহলি লিখেছিলেন, উত্তর ভারতের নানা বেকার লুম্পেন গোষ্ঠী দক্ষিণপন্থী পার্টি বিশেষত আরএসএসে যোগ দিয়েছে। মোদির শাসনের শুরুতে যখন স্বঘোষিত গো-রক্ষকরা দাপট দেখাতে আরম্ভ করল, তাদের মধ্যেও লুম্পেনদের ছায়া দেখেছেন পবন ভার্মা বা ভালচন্দ্র মুঙ্গেকরের মতো লেখক-আমলা-রাজনীতিকরা।

এই বাংলাতেও প্রতিটি শহরে ঘুরুন। সর্বত্র প্রবীণদের প্রশ্ন করলে, সেই আমলের পাড়ার দাদাদের কথা শোনা যাবে। যারা সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। কেউ ছিনতাইবাজ, কেউ ওয়াগনব্রেকার, কেউ তোলাবাজ, কেউ মন্ত্রীর ঘোষিত দেহরক্ষী। শিলিগুড়িতে যেমন এখনও অনেকে মনে রেখেছেন ডুগি-প্যালা-বুঢ্ঢু-সুভাষ-প্রদীপদের। মালদায় উজ্জ্বল-বাপি-হাবুয়া। কোচবিহারে সুভাষ। আলিপুরদুয়ারে নন্দুরাম, খোকন, যতীন। আসানসোলে যেমন গড়ে ওঠে প্রিন্স, যিশু, ফুফা, ঝালপুরিয়া, কুরবান, মোহনা। বীরভূমে অনুব্রত-কাজল শেখদের আগের যুগে চোবে, সাধন, সাহেব, জজ, জন, অলোক।

এরা কেউ অতীতে শাহজাহান স্টাইলে বাইক নিয়ে ঘুরত। তোলাবাজি-দাদাগিরিতে ওস্তাদ। পরীক্ষা হলে গার্ড দিতে চলে যেত অধ্যাপক হয়ে। সুন্দরী ছাত্রীদের হুমকি দিত তুলে নিয়ে যাব বলে। কোচবিহারে পসারিহাটে সিপিএম-ফরওয়ার্ড ব্লকের যুদ্ধে অনেককে জীবন্ত পুঁতে দেওয়ার গল্প এখনও অনেকে করেন। দিনহাটায় রামদা নিয়ে কবে থেকে ঘুরে বেড়াত কত মস্তান।

মালদায় অতি পরোপকারী কুলদীপকে খুন করার পিছনে শোনা যায় উজ্জ্বল-হাবুয়ার নাম। যাদের মানুষই শেষ করে দেয়। মালদা স্টেশন থেকে সামান্য দূরে বড় রাস্তায় বটতলার নীচে কুলদীপ মিশ্রের নামে ছিল ছোট এক বেদি। তাতে লেখা, ‘কুলদীপ মিশ্র অমর রহে’।

বহু বছর পর ঝলঝলিয়ার ঝলমলে পথে কুলদীপ মিশ্রের নামে স্মৃতিফলকটি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। বট গাছের নীচে আজ মন্দির। কুলদীপের নামে স্তম্ভটি কোথায় গেল? অনেক অবাঙালির এখন দোকান সেখানে। হিন্দিভাষীরা বললেন, স্তম্ভ যেখানে ছিল, সেখানে এখন নতুন হোটেল। রেললাইনের ওপারে হয়েছে কুলদীপ মিশ্র কলোনি। বর্তমান রাজনীতিক ও হোটেল ব্যবসায়ীদের দায় পড়েছে ওই ছোট্ট স্তম্ভকে মনে রাখতে! বাংলার সব জেলা শহরে কত শহিদ স্তম্ভ তুলে দিয়েছে নেতা আর ব্যবসায়ী মিলে।

এতসব যন্ত্রণা-আক্ষেপের মাঝে আশাভরসার কথা একটাই। লোকে কুলদীপদের মনে রাখে আজীবন, আমৃত্যু। শাহজাহানরা তলিয়ে যায় কুখ্যাতির স্মৃতির অতলে।

Uttarbanga Sambad
Uttarbanga Sambadhttps://uttarbangasambad.com/
Uttarbanga Sambad was started on 19 May 1980 in a small letterpress in Siliguri. Due to its huge popularity, in 1981 web offset press was installed. Computerized typesetting was introduced in the year 1985.
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
- Advertisment -spot_img

LATEST POSTS

বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ গোসানিমারিতে

0
সিতাই: বেহাল সেতু সংস্কারের দাবিতে পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন বাসিন্দারা। মঙ্গলবার ঘটনাটি ঘটেছে দিনহাটা ১ ব্লকের গোসানিমারিতে। প্রায় দু'ঘণ্টা চলে অবরোধ। স্থানীয় সূত্রে...

Accident | ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা, গুরুতর আহত তিন

0
কুমারগঞ্জ: ভুটভুটির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটল। সোমবার রাত আটটা নাগাদ কুমারগঞ্জ থানার জাখিরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তুলোট মোড় এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন তিনজন।...

Cyclone | চলতি মাসে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা বাংলায়

0
শিলিগুড়ি: চার বছরের ব্যবধানে ফের কি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মুখে পড়তে চলেছে বাংলা? বঙ্গোপসাগরে একটি সিস্টেম তৈরি হতে থাকায়, এই আশঙ্কা করছেন আবহবিদরা। তার মধ্যে...

Bagdogra | লোয়ার বাগডোগরায় অবৈধভাবে চলছে ক্র্যাশার, নীরব প্রশাসন

0
খোকন সাহা, বাগডোগরা, ১৩ মে : একদিকে নদী লুট, অন্যদিকে সেই লুটের বোল্ডার দিয়ে অবৈধভাবে চলছে ক্র্যাশার। সরকারি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এমনটাই চলছে...

Siliguri | সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডের গাছ অন্যত্র প্রতিস্থাপনে পরিবেশ কমিটির বৈঠক

0
শিলিগুড়ি: শিলিগুড়ির সেবক রোড এবং বর্ধমান রোডে রাস্তা সম্প্রসারনের জন্যে ১৭৯টি গাছ অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে হবে। গাছগুলি কোথায় স্থানান্তর করা হবে তা নিশ্চিত করতে...

Most Popular