- রুদ্র সান্যাল
সম্প্রতি ইংল্যান্ডের সব স্কুলের সব ক্লাসরুমে মুঠোফোন নিষিদ্ধ করেছেন সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্কুলে মুঠোফোন তীব্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ছাত্রছাত্রীদের মনে। এমনকি নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বিষয়টা সঠিকভাবে বোঝানোর জন্য।
কী অদ্ভুত বিষয় না? অতি উন্নত দেশ ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের তথাকথিত উন্নত দেশ ভারতের স্কুলগুলোর অবস্থান এই মুহূর্তে একই রকম। এক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য হয়নি। সম্প্রতি আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রেও যেভাবে ছাত্রছাত্রীরা মুঠোফোন নিয়ে আসা শুরু করেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা হল থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আবার বলা যায়, স্মার্টফোন এক ভয়াবহ দুর্গতির দিকে নিয়ে চলছে নতুন প্রজন্মকে।
একটি গ্রামীণ উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে চাকরির সুবাদে বেশ কয়েকবছর ধরেই লক্ষ করছি কীভাবে স্মার্টফোনে গ্রাস হয়ে যাচ্ছে অনেক ভালো ভালো ছেলেমেয়ে। যারা নীচু শ্রেণিতে পড়াশোনায় ভালো ছিল, তারা কীভাবে যেন ঝিমিয়ে পড়েছে উঁচু ক্লাসে। একইসঙ্গে চূড়ান্ত অমনোযোগী। খবর নিলেই জানতে পারা যায়, তাদের আসক্তি স্মার্টফোনে। পড়াশোনা সব মাথায় উঠে গিয়েছে!
আজকে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কথা উঠছে। এই সমস্যা আজকের নয় অতীতেও ছিল। কিন্তু বর্তমানে স্মার্ট মুঠোফোনের কারণে তা অনেক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। যদিও এই বছর প্রশ্নপত্রে বার কোডের কারণে অনেকটাই তা আটকানো সম্ভব হয়েছে। তবুও এইসব ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়েছে শুধুমাত্র স্মার্টফোনের অপকারিতা আটকানোর জন্যে।
বিদেশেও একই অবস্থা! মুঠোফোন সংস্কৃতিতে বই পড়ার অভ্যাস ছাত্রছাত্রীদের জীবন থেকে প্রায় বিলুপ্ত। পড়াশোনার এই অধঃপতনের অন্যতম কারণ কোভিড পরিস্থিতির অনলাইন পড়াশোনা। বর্তমানে এই অনলাইন মোড থেকে অফলাইন মোডে এইসব ছাত্রছাত্রীকে ফিরিয়ে আনাটাই এক চ্যালেঞ্জ। পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা বর্তমান সময়ে একজন সাধারণ মানের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই স্মার্ট মুঠোফোন। এটাই নির্মম বাস্তব।
শিক্ষা ব্যবস্থার হাল খারাপ এবং সরকারের শিক্ষানীতি নিয়ে আমরা সবাই চায়ের কাপে তুফান তুলি। কিন্তু সমস্যার সমাধান আমরা কেউই সেভাবে করতে পারছি না। কোভিডকালে স্মার্টফোন হয়তো পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যে কিছুটা দরকার ছিল। কিন্তু তার জন্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের বর্তমানে স্মার্ট ট্যাব না দিলেও চলত। একদিকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার আদানপ্রদান ব্যবস্থা চূড়ান্ত ব্যর্থ। পাশ-ফেল প্রথাই একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক মূল্যায়নের।
একদিকে গ্রামীণ এলাকায় অস্বাভাবিক রকম শিক্ষকের ঘাটতি। যার কারণে বিশেষত বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা প্রকট। ফেল না করার অভ্যাস থেকেই ছেলেমেয়েরা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সেই কারণে নৈতিকতা বোধও তাদের একটা বৃহৎ অংশের মধ্যে নেই। টেস্টে ফেল করলেই শুরু হয় আন্দোলন। শিক্ষকরা হন বলির পাঁঠা। দুর্ভাগ্য এটাই।
(লেখক বিধাননগর সন্তোষিণী বিদ্যাচক্র হাইস্কুলের শিক্ষক)