- গ্রন্থন সেনগুপ্ত
মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া, চাপ চাপ কুয়াশা জমেছে হলুদ স্ট্রিট লাইটের নীচে। হাতগ্লাভস পরে রাত ১১টা নাগাদ পড়া থেকে যখন ফিরতাম ২৪ তারিখ রাতে, তখন কুয়াশার রং বদলে লাল-নীল-সবুজ হযে উঠেছে। হলুদ আলো রাস্তায় জায়গা করে নিয়েছে টুনি বালবের রোশনাই। ডিনার সেরে এক টুকরো কেক খুঁজে ঘুমিযে পড়তাম। কাল ক্রিসমাস।
ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে সাদা ইওয়ান বাস চলেছে। যাব হাওড়া। জানলা হালকা খোলা রেখেছি বলে সহযাত্রী মোটেই খুশি নন। আবছা আবছা আলো ভেসে বেড়াচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের এই রাস্তায়। চশমায় আলোর রিফ্লেকশন রং বদলাচ্ছে বারবার। হঠাৎই থেমে গেল বাস। পাশের লোকটি বেশ বিরক্তির স্বরেই বললেন ‘আমাদের সমযে তো শুধু ২৫ তারিখ ভিড় হত। এখন দেখছি ২৪ তারিখ থেকেই শুরু হযে গিয়েছে।’ বাস ছাড়তেই কুয়াশায় সাগরে ভাসমান আলোর জলকেলি দূরে চলে গেল ঠিকই, তবে জানান দিয়ে গেল কাল ক্রিসমাস।
বদলেছে সময়। বদলেছে দিনকাল। সাইকেলে চড়িনি প্রায় ৫ বছর হয়ে গিয়েছে। শহর কলকাতার শীতে মুখ দিয়ে ধোঁয়াও বের হয় না। তবে ক্রিসমাসের উন্মাদনা যদিও তাতে কমেনি। কলকাতার নিয়ন আলোর ভিড়ে যখন রংমশালের মতো টুনি বালবের রোশনাই চোখে এসে লাগে, তখন চোখ পৌঁছে যায় আমাদের জলপাইগুড়ির সেই ছোট্ট চার্চটার সামনে। বাবার সঙ্গে প্রথম এসেছিলাম যেখানে। ইউরোপীয় ধাঁচে গড়া জলপাইগুড়িতে তাই কখনোই ভাইফোঁটায় উৎসব শেষ হয়ে যেত না। চলত ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিজয়ার মিষ্টির স্বাদ মুখ থেকে যেতে না যেতেই কেকের গন্ধে মনটা নেচে উঠত ছেলেবেলায়। তবে, ছোট শহর। তাই আড়ম্বর কম। কিন্তু আবেগ কম নয়। শহরের যে কটা চার্চ রয়েছে সেখানে তাই ছোট থেকেই ভিড় দেখে অভ্যাস। ঠান্ডায় কেঁপে কাগজের কাপে কফি এবং রাংতায় মোড়া সস্তা কেকেই জলপাইগুড়ির বিলেতযাপন।
জলপাইগুড়ি ছেড়ে যখন নগর কলকাতায় এলাম, তখন ছোটবেলার স্মৃতিগুলো প্রায়শই বর্ষার বৃষ্টির মত ঝাপটা মারত মনের আঙিনায়। প্রথম দিকে চোখের কোণটা একটু ভিজলেও, এখন আর ভেজে না। তবে, আবাস বদলে গেলেও অভ্যাস বদলায় কি? হযতো না। আর না বলেই প্রতি বছর পার্ক স্ট্রিট কিংবা বো ব্যারাকের আমেজটা মিস করতে ইচ্ছে করে না। একবার তো কালো লং কোট পরে প্রায় সাহেবি কায়দায় পার্ক স্ট্রিট চলে গিয়ে কী বিপদে পড়লাম। ঠাসা ভিড়ে ঘেমে নেয়ে একাকার। বেরিযে এসে মনে হল এটা শুধু বিলেতের সেটই বটে, আবহাওয়াটা বিলেত কেন, উত্তরবঙ্গের মতোও নয়। তারপর থেকে বেশ কয়েকটা বছর কেটে গিয়েছে। আলোর নাগরদোলায় পার্ক স্ট্রিট সেজে উঠেছে প্রতিবার। বড় শহর। বিরাট আড়ম্বর। তবে, মিস করি আবেগটাকে। যেই আবেগ জলপাইগুড়িতেই ট্রাভেল করাতে পারে লন্ডনের রাস্তায়, ঘুরিয়ে আনতে পারে টাইমস স্কোযার। তবে, এসব এখন শুধু মনে আসে বছরে এক-আধবার। মনে থাকে না কিছুই। আসলে কলকাতার শীতটা হয়তো আলগা, উৎসবের বাঁধনটা তো নয়।
(জলপাইগুড়ির বাসিন্দা। এখন থাকেন কলকাতায়)