- সুমন ভট্টাচার্য
সালটা ১৯৪৩। সুভাষচন্দ্র বসু তখন সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য মরিয়া হয়ে অর্থসংগ্রহ করছেন। এমন সময় তাঁর কাছে খবর এল, যদি তিনি সিঙ্গাপুরের প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী বিত্তবান তামিল চেট্টিয়ার গোষ্ঠীগুলির মন্দিরে যান, তাহলে তাঁরা যথেষ্ট অর্থ দান করবেন। চেট্টিয়ারদের মন্দিরে তিনি যাবেন কী করে? কারণ সেখানে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি তাঁর বাহিনীতে শিখ, মুসলিম খ্রিস্টানদের সমান গুরুত্ব দিতেন, তিনি তো সেই অন্য ধর্মাবলম্বী অফিসারদের না নিয়ে যাবেন না।
শেষপর্যন্ত নেতাজি গেলেন এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর শিখ, মুসলিম, খ্রিস্টান অফিসারদের নিয়েই গেলেন। মন্দির থেকে বেরিয়ে যখন তিনি কপালের তিলক মুছে ফেলছেন, তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন মুছে ফেলছেন? সুভাষচন্দ্র বসুর জবাবটা বোধহয় আমাদের মনে রাখা উচিত। নেতাজি বলেছিলেন, ওটা ব্যক্তিগত বিষয়।
এই যে ‘ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়’ বলে যিনি মনে করতেন, যে নেতাজি ব্যক্তিজীবনে বারবার কালীপুজোর কথা বলেও, সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে সব ধর্মকে সমান স্থান দেওয়ার কথা বলতেন, সেই সুভাষের মতাদর্শ কিংবা রাজনৈতিক গুরুত্ব কি আজকের ভারতে ফিকে হয়ে এসেছে? দেশজুড়ে রাম মন্দির নিয়ে উন্মাদনার চেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতজুড়ে মন্দিরে যাওয়া হয়তো এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করায়।
এ বিষয়ে কোনও সংশয় রাখার দরকার নেই যে জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র, দুজনেই ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় বলে মনে করতেন। রাজনৈতিক দিক থেকে সমাজতন্ত্রকে অনুসরণ করতেন বা বামপন্থী ছিলেন। ঐতিহাসিক সমাপতন এটাও যে, এই ২০২৪-এ গোটা দেশে নেতাজির প্রতিষ্ঠিত দল ফরওয়ার্ড ব্লকের একজনও বিধায়ক বা সাংসদ নেই! পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে পঞ্চায়েত পর্যায়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়তো বা কিছু জনপ্রতিনিধি আছেন, কিন্তু তা বাদ দিলে রাজনৈতিক পরিসরে নেতাজির দল গুরুত্ব হারিয়েছে। নেহরুর কংগ্রেসও ধর্মকেন্দ্রিক এই রাজনীতির দাপটে যথেষ্টই কোণঠাসা। কিন্তু আজকের কংগ্রেস যে ইন্ডিয়া জোটকে নিয়ে এগিয়ে চলতে চাইছে, সেই বিরোধী রাজনৈতিক ব্লকেই বা ফরওয়ার্ড ব্লক কোথায়?
কেন আজ দেশে ফরওয়ার্ড ব্লককে খুঁজতে দূরবিনও নয়, মাইক্রোস্কোপ দরকার তা বোঝার জন্য বিজেপি বা আরএসএসের আঁতুড় নাগপুরের দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে। আজকের ভারত যতই নাগপুরকে চিনুক আরএসএসের সদর দপ্তরের শহর হিসেবে কিংবা বিজেপির শীর্ষ নেতা নীতিন গড়করি বা দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বিদর্ভে রাজনৈতিক আধিপত্য দেখান না কেন, একসময় ‘বিদর্ভের সিংহ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন জম্বুবন্তরাও ধোটে। নেতাজির একনিষ্ঠ ভক্ত ধোটে বিদর্ভ থেকে পাঁচবার বিধায়ক হয়েছিলেন, দু’বার সাংসদ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের জনপ্রতিনিধি হিসেবে। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি ইন্দিরা গান্ধির ডাকে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে হাত চিহ্ন নিয়ে সাংসদও হয়েছিলেন।
বিদর্ভের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, একসময় ধোটে সেই অঞ্চলে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রায় ২২ জনকে বিধানসভায় জিতিয়েও এনেছিলেন। রাজনৈতিক জীবনের শেষে এসে ধোটে আবার ফরওয়ার্ড ব্লকেই ফিরে কেজরিওয়ালের আপের অনুকরণে পুরোনো দলকে রাজনৈতিকভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর বিদর্ভে আর ফরওয়ার্ড ব্লককে নিয়ে কেউ আলোচনা করে না। যে বিদর্ভে ফরওয়ার্ড ব্লকের সিংহ প্রতীকের কথা মাথায় রেখে নেতাকে ‘বিদর্ভের সিংহ’ আখ্যা দেওয়া হয়, সেখান থেকে নেতাজির প্রতিষ্ঠিত দলের প্রায় উবে যাওয়া দেশে ফরওয়ার্ড ব্লকের অস্তিত্বের সংকটকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব দিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর পরাধীন দেশে কিছুদিন ফরওয়ার্ড ব্লক নিষিদ্ধ দল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে বারবারই দল ভেঙেছে। নেতাজির পার্টি মূলত দুটি আদর্শগত প্রশ্নে বারবার আলোড়িত হয়েছে।
প্রথমটি অবশ্যই ফরওয়ার্ড ব্লককে তুলে দিয়ে নেতাজি সমর্থকদের কংগ্রেসে ফেরত চলে যাওয়া উচিত কি না। ১৯৫৭ সাল থেকে কংগ্রেস তাদের ইস্তাহারে সমাজতন্ত্রের কথা বলতে শুরুর পর থেকেই নেতাজি অনুগামীরা বারবারই দোদুল্যমানতায় ভুগেছেন। তাঁদের কি আলাদা রাজনৈতিক দল করা উচিত, না যে দল ভেঙে সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করেছিলেন সেই কংগ্রেসে ফেরত চলে যাওয়া উচিত? এবং উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো বহু রাজ্যে, যেখানে একসময় ফরওয়ার্ড ব্লকের ঝান্ডা উড়ত, সেখানে সুভাষ অনুগামীরা কংগ্রেসের পতাকার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতন দেখুন, রাহুল গান্ধি যখন উত্তরবঙ্গে তাঁর ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা নিয়ে ঢুকবেন, তখনও কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতে হাজির থাকবেন এমন দুজন, যাঁরা আগে ফরওয়ার্ড ব্লক করতেন। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী হাফিজ আলম সৈরানি এবং প্রাক্তন বিধায়ক আলি রমজ ভিক্টর।
ফরওয়ার্ড ব্লক দ্বিতীয় যে আদর্শগত প্রশ্ন নিয়ে বারবার ভাঙনের মুখোমুখি হয়েছে, তা দল হিসেবে কতটা সুভাষচন্দ্রের আদর্শকে অনুসরণ করবে আর কতটা বামপন্থী হবে! পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে তো এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শাসক জোট বামফ্রন্টের মধ্যেই দুটি দল ছিল, মূল ফরওয়ার্ড ব্লক এবং রাম চ্যাটার্জির মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, কমিউনিস্টদের পিছনে হাঁটতে গিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতাজির রাজ্যে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। যখন ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বামফ্রন্টকে সরালেন, তখন অনেক জেলাতেই ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা-কর্মীরা, লাল পতাকা ছেড়ে তেরঙা পতাকা ধরে নিতে দ্বিধা করেননি। উত্তর ২৪ পরগনা, বীরভূম কিংবা উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে আজকের শাসকদল তৃণমূল পুষ্ট হল ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা-কর্মীদের দলে টেনেই।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে ফরওয়ার্ড ব্লক রাজনৈতিক পরিসরে স্যর দুখীরাম মজুমদারের এরিয়ান ক্লাব ছিল? এরিয়ান থেকে খেলোয়াড় নিয়ে একসময় যেমন কলকাতার বড় দলগুলি তারকা বানাত, নেতাজির দলও অন্য রাজনৈতিক শক্তিদের নেতা জুগিয়েছে? আজকের পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক চিত্র দেখলে সেই রকমটাই মনে হতে পারে। ক্ষমতাসীন তৃণমূল তো বটেই, বিরোধী গেরুয়া শিবিরেও ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে অনেকে গিয়েছেন। মজার কথা, ফরওয়ার্ড ব্লকের বড় অংশই এখন রাহুল গান্ধির নামে স্লোগান দিচ্ছে!
এই রাজনৈতিক ক্ষয়ের মুখে দাঁড়িয়ে নয়াদিল্লিতে গুরদোয়ারা রকাবগঞ্জ রোডে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর আছে। কিন্তু সেই দপ্তরে গোটা দেশের কারা জনপ্রতিনিধি হয়ে পৌঁছাবেন, সেই নিশ্চয়তা কোনও রাজ্য থেকেই নেই! নয়াদিল্লিতে দলের দায়িত্ব সামলান দক্ষিণী নেতা ডি বরদারাজন। যে তামিলনাডুতে একসময় নেতাজি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের যথেষ্ট অস্তিত্ব ছিল, সেখানে এখন দ্রাবিড় ভাষায় লেখা ফরওয়ার্ড ব্লকের ফেস্টুন দেখা যায় কিন্তু বরদারাজন ভোটে জিততে পারেন কোথায়? মণিপুর যখন জ্বলছিল, তখনই বা ফরওয়ার্ড ব্লক উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যের সঙ্গে সুভাষ বসুর যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল, তার কথা কতটা তুলে ধরতে পেরেছিলেন? বাংলার নরেন চট্টোপাধ্যায় কলকাতার সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার্টি অফিস আঁকড়ে বসে। কিন্তু আর কোনও নেতা নেই বাংলায়। দল আটকে আছে এক জায়গায়।
যেখানে দলের অস্তিত্বই এতটা বিপন্ন, সেখানে সুভাষচন্দ্রের ‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং সমাজ’-এর কথা, তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের কথা কারা বলবেন? পার্টির অনেক প্রাক্তন নেতা-কর্মী সেইজন্য মজা করে বলেন, ওই জন্যই তো আমরা তৃণমূল কিংবা কংগ্রেসের ঝান্ডা ধরে নিয়েছি। যেখানে এখনও নেতাজির আদর্শের কথা উচ্চারিত হয়।’
(লেখক সাংবাদিক)